প্রবন্ধ

দস্তয়েভস্কির জীবন ও সাহিত্য।।চায়না ব্যানার্জি

fyodor_dostoevsky chaina banerzy mohapoth

উনবিংশ শতাব্দীর ত্রিশের দশকের প্রথমদিকে রুশ সাহিত্যের প্রধান কবি আলেকসান্দার পুশকিন বলেছিলেন গদ্য সাহিত্য বলতে রুশ সাহিত্যে এখন পর্যন্ত যা আছে তা হচ্ছে নিকোলাই কারমাজিনের বার খণ্ডের রাশিয়ার ইতিহাস। পুশকিনের এ উক্তি অতিশয় ব্যাঙ্গাত্মক হলেও এটা ঠিক যে, পুশকিন এবং গোগলের আবির্ভাবের আগে রুশ সাহিত্যে বিশ্বসাহিত্য ছিল একেবারেই অপরিচিত। উনবিংশ শতাব্দিতেই রুশ সাহিত্য বিশ্ব সাহিত্যের দরবারে স্বমহিমায় উদ্ভাসিত হয়। সমাজে প্রতিষ্ঠিত দাসপ্রথা এবং জারের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের প্রধান মাধ্যম, শিল্প সাহিত্য জগৎ সমাজের সচেতন, অসরব্যক্তিদের প্রবলভাবে আকৃষ্ট করে। আর এ সময় রাশিয়ায় আবির্ভাব ঘটেছে পুশকিন, গোগল, গের্সেন, লেরমন্তভ, তুর্গেনেভ, দস্তয়েভস্কি, নেক্রাসভ, চেরনিশেভস্কি, তলস্তয় প্রভৃতি বিশ্ববরেণ্য সাহিত্যিকদের।

ফিওদর মিখাইলোভিচ দস্তয়েভস্কি রুশ তথা বিশ্ব সাহিত্যে এক উজ্জ্বল নাম। ১১ নভেম্বর ১৮২১ সালে তিনি মস্কোয় জন্মগ্রহণ করেন। ১৮৪৫ সালে তার প্রথম উপন্যাস পুওর পিউপিল (বেদ নিয়ে লুদি) প্রকাশিত হয়। উপন্যাসটি শুরু হয়েছে সমাজের নিচু তলার একজন বয়স্ক নিুপদস্থ কর্মচারী এবং অল্প বয়সী যুবতীর মধ্যে পত্র বিনিময়ের মাধ্যমে, যাকে ইতিমধ্যে পিতা-মাতা ও প্রেমিকের মৃত্যু, মক্কেল দ্বারা সর্বদা অনুসরণসহ চরম দুঃখ-দুর্দশার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। মাকার দেভুসকিন এবং ভারিয়েস্কা দবরাসিয়েলভা একে অপরের প্রতি সংবেদনশীল, সহানুভূতিশীল। মন-মানসিকতায় অত্যন্ত স্বচ্ছ ও পবিত্র। এদের সামর্থ্য সামান্য হাত-পা বাঁধা কিন্তু একে অপরকে সাহায্য করতে উদগ্রীব। অর্থনৈতিকভাবে দুর্দশাগ্রস্ত হলেও মনের দিক থেকে এরা সমৃদ্ধ। উপন্যাসটি শেষ হয়েছে এক করুণ পরিণতির মধ্য দিয়ে অত্যাচারী জমিদার দ্বারা ভারিয়েস্কা অপহৃত হয় আর ইতিমধ্যে মানসিকভাবে ভারিয়েস্কার প্রতি নির্ভরশীল হয়ে পড়া নিঃসঙ্গ মাকার এক সর্বগ্রাসী দুঃখের অতল গহ্বরে নিপতিত হয়। বস্তুত তৎকালীন রুশ সমাজের নিচতলার মানুষের নিরাপত্তাহীনতা, অর্থনৈতিক ও সামাজিক নিষ্পেশনের করুণ চিত্রের দলিল এ উপন্যাস। তৎকালীন বিখ্যাত রুশ সাহিত্য সমালোচক বেলনস্কি উপন্যাসটির উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করে বলেন, ‘এ উপন্যাসে জীবনের এমন সব রহস্য উন্মোচিত হয়ে যা এর আগে কারও আবিষ্কার করা সম্ভব হয়নি।… রাশিয়াতে সামাজিক উপন্যাস লেখার এটাই প্রথম প্রচেষ্টা’। এ সময়ে বেলনস্কির সঙ্গে তরুণ দস্তয়েভস্কির প্রথম সাক্ষাৎ হয়। দস্তয়েভস্কি পরবর্তীতে এ মুহূর্তটিকে তার জীবনের সবচেয়ে স্মরণীয় মুহূর্ত হিসেবে উল্লেখ করে বলেছেন, এটি ছিল জীবনের সংকটময় মুহূর্তে পরম অনুপ্রেরণার উৎস। প্রথম উপন্যাস প্রকাশিত হওয়ার পর দস্তয়েভস্কি ব্যাপক পরিচিত হয়ে ওঠেন। চাকরিতে অনিহা এবং সরকারি চাকরিতে লেখালেখির সীমাবদ্ধতা বিবেচনায় নিয়ে তিনি চাকরি ছেড়ে দিয়ে লেখালেখিতে পুরোপুরি মনোনিবেশ করেন।

সে কয়েক মাস ধরে একজন নির্দয়, সুদখোর কিন্তু ধনী বুড়িকে (এলেয়ানা ইভানোভনা) হত্যার পরিকল্পনা করে। সে মনে মনে এ ধারণা দ্বারা আচ্ছন্ন হতে থাকে যে মানুষ দুভাগে বিভক্ত একদল হচ্ছে ইতর শ্রেণীভুক্ত অন্যদল হচ্ছে অসাধারণ। সেভাবে এ বুড়ি সমাজের জন্য ক্ষতিকর।

১৮৪৯ সালে সংঘটিত একটি ঘটনা দস্তয়েভস্কির জীবন ও সাহিত্যকে দু’ভাগে ভাগ করে দিয়েছে। উনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে জার প্রথম নিকোলাসের অত্যাচারের বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ মানুষের প্রতিবাদ দানা বাঁধতে থাকে। একটি ইতিবাচক পরিবর্তনের জন্য বিপ্লবী গণতন্ত্রীরা নানাভাবে সংঘটিত হচ্ছিল। সমাজের নিপীড়িত মানুষের আশা-আকাক্সক্ষার ধারক হয়ে দাঁড়ায় তারা। মূল ধারার লেখকরা লেখনীর মাধ্যমে তাদের সঙ্গে সামিল ছিলেন। দস্তয়েভস্কির সঙ্গে এদের বিস্তর মতপার্থক্য থাকলেও সমাজের ইতিবাচক পরিবর্তনে তিনি ছিলেন আগ্রহী। ইউটোপিয়ান সোস্যালিস্ট ভাবনায় বিশ্বাসী প্রগতিবাদী সাহিত্যিকের একটি চক্রে ১৮৪৭ সাল থেকে তার যাতায়াত ছিল। এ চক্রের সদস্যদের কার্যক্রম আলাপ-আলোচনার মধ্যে সীমিত থাকলেও রাষ্ট্রবিরোধী হিসেবে ইতিমধ্যে বিবেচিত গোগলের কাছে বেলনস্কির লেখা একটি চিঠি প্রচারের দায়ে দস্তয়েভস্কিসহ চক্রের সদস্যদের গ্রেফতার করা হয়। সেন্ট পিটার্সবুর্গের পিটার অ্যান্ড পল কারাগারের নির্জন প্রকষ্ঠে আটক থাক দস্তয়েভস্কি বিচারে দোষী সাব্যস্ত হওয়ায় তার পুরো সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত, পদবি প্রত্যাহারসহ প্রকাশ্যে গুলি করে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার আদেশপ্রাপ্ত হন।

জার নিকোলাস মৃত্যুর আগে সাজাপ্রাপ্তদের কঠোর স্নায়ুবিক পীড়নের সিদ্ধান্ত নেন। সাজাপ্রাপ্তদের মৃত্যুদণ্ডাদেশ কার্যকরের জন্য পূর্বনির্ধারিত প্যারেড গ্রাউন্ডে, হাজির হয়ে পোস্টে হাত বেঁধে কালো কাপড়ে চোখ ঢেকে দিয়ে রাষ্ট্রীয় ও ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা শেষ করা হয়। বন্দুকের নল তাক করে রাখা হয়েছে। শেষ সতর্ক ঘণ্টা বাজানোও হয়ে গেছে। কয়েক মুহূর্ত পর সবার ভবলীলা সাঙ্গ হবে। মৃত্যুর শীতল স্রোত বয়ে যাচ্ছে সবার মধ্য দিয়ে। এমন সময় জার নিকোলাস মৃত্যু দণ্ডাদেশ স্থগিত ঘোষণা করেন। দস্তয়েভস্কিকে চার বছরের সশ্রম কারাদণ্ডসহ বাধ্যতামূলক সামরিক চাকরির আদেশ দেয়া হয়। জেলে যাওয়ার আগে তিনি তার ভাইকে লেখেন, ‘প্রায় পৌনে এক ঘণ্টা মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়েছিলাম, জীবিত থেকেও জীবনের একেবারে শেষ মুহূর্তে পৌঁছেছিলাম। দেহে এখন জীবনের উপস্থিতি টের পাচ্ছি’।

জেল জীবনে দস্তয়েভস্কি নানা ধরনের লোকের সংস্পর্শে আসেন। তিনি এখানে মানুষের অতলস্পর্শী মনোজগৎ পর্যবেক্ষণ করার অভিজ্ঞতায় সিক্ত হন যা তার পরবর্তী সাহিত্য জীবনে ব্যাপক প্রভাব ফেলে। ১৮৫৪ সালে দস্তয়েভস্কির কারা জীবনের অবসান হওয়ার পর শুরু হয় বাধ্যতামূলক সৈনিক জীবন। ১৮৫৭ সালে তিনি মারিয়া ইসায়েভার সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। শেষ পর্যন্ত ১৮৫৯ সালে শেষ হয় তার সৈনিক জীবন এবং তিনি পুনরায় সেন্ট পিটার্সবুর্গে বসবাসের অনুমতি পান।

crime and punishment mohapoth

কন্সট্যানস গারনেটকৃত ইংরেজী অনুবাদের প্রচ্ছদ (১৯৫৬)

দস্তয়েভস্কি তার ভাইয়ের সঙ্গে যৌথ সম্পদনায় The The প্রকাশের মাধ্যমে সাহিত্যাঙ্গনে দ্বিতীয় পর্বের সূচনা করেন। এ পত্রিকায় প্রথম সংখ্যায় তার The Humiliated and Insulted (1861) প্রকাশিত হয়। পাঠক মহলে সমাদৃত পত্রিকাটি নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করায় শাসকদের রোষানলে পড়ে অচিরেই বন্ধ হয়ে যায়। The Insulted and Injured এ একটি ডিটেক্টিভ গল্পের মাধ্যমে সেন্ট পিটার্সবুর্গের বঞ্চিত-লাঞ্ছিত মানুষের বাস্তব জীবন উপস্থাপন করা হয়েছে যা Poor People এর ধারাবাহিকতা মাত্র। এক বিবর্ণ, বিষণ্ণ, তিমিরাচ্ছন্ন, যন্ত্রদায়ক, হৃদয় বিদারক করুণ ইতিহাসের প্রতিচ্ছবি। সমাজের বঞ্চিত, লাঞ্ছিত, অসুখী, ভুলে যাওয়া মানুষের সামনে এগিয়ে যাওয়ার যেন কোনো পথ আর খোলা নেই। এরপর একে একে প্রকাশিত হয় তার বিখ্যাত উপন্যাসগুলো। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে The House of The Dead (1862), Notes from Underground (1864), Crime and Punishment (1966), The Idiot (1869), The Brother Karmazov (1880)। এদের প্রত্যেকটি হচ্ছে Master peace, বিশ্ব সাহিত্যের অবিচ্ছেদ্য অংশ।

Crime and Punishment উপন্যাসে লেখক এ উপন্যাসের নায়ক রাশকলনিকভের মনোজগতের ওপর আলোকপাত করেছেন। একজন মানুষের অপরাধ করার প্রবৃত্তি ও অপরাধ পরবর্তী মানসিক অবস্থা উদঘাটন করা ছিল দস্তয়েভস্কির অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য। রাশকালনিকভ একজন আইনের ছাত্র। অর্থাভাবে তার পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যায়, আর্থিক দৈন্য তাকে বিকারগ্রস্ত করে তোলে। সে কয়েক মাস ধরে একজন নির্দয়, সুদখোর কিন্তু ধনী বুড়িকে (এলেয়ানা ইভানোভনা) হত্যার পরিকল্পনা করে। সে মনে মনে এ ধারণা দ্বারা আচ্ছন্ন হতে থাকে যে মানুষ দুভাগে বিভক্ত একদল হচ্ছে ইতর শ্রেণীভুক্ত অন্যদল হচ্ছে অসাধারণ। সেভাবে এ বুড়ি সমাজের জন্য ক্ষতিকর। তাকে হত্যা করা হবে একটি কল্যাণকর কাজ এবং ধন-সম্পত্তি শুভ কাজে ব্যবহার করলে সে অসাধারণ শ্রেণীর কাতারে শামিল হবে। ইতর শ্রেণীভুক্ত মানুষের জন্য যেসব আইন প্রজোয্য অসাধারণদের জন্য তা প্রজোয্য নয় কারণ তারা অসাধারণ। যে আইন সমাজে কাজ করে না বা কখনও তা ব্যবহার করা হয়নি, মহান উদ্দেশ্যে তা ভাঙা কোনো অপরাধ নয়। সে তার পরিকল্পনা মোতাবেক বুড়িকে হত্যা করে এবং এই হত্যাকে ধামাচাপা দেয়ার জন্য আরও একজনকে খুন করে। খুন পরবর্তী ঘটনা পরম্পরায় তাকে মানসিক বিকারগ্রস্ততায় পেয়ে বসে। সে অস্থির, উদভ্রান্ত জীবনযাপন করা শুরু করে। তার ব্যর্থতা এই যে, সে তার অপরাধ বুঝতে পারে না। সে তার অসাধারণ হওয়ার তত্ত্বের মধ্যে মগ্ন থাকে। কিন্তু সোনিয়া নামক একজন পতিতা, সে বাস্তবে একজন খাঁটি খ্রিস্টান তার সংস্পর্শে এসে রাশকালনিকভের মানসিক পরিবর্তন শুরু হয়। এক পর্যায়ে সে তার দোষ স্বীকার করে। বিচারে তার সাইবেরিয়ায় নির্বাসন হয়। এবং সোনিয়ার প্রভাবে তার জীবনবোধের পরিবর্তন শুরু হয়।

______________ 

 

লেখা সম্পর্কে মতামত জানাতে ফেসবুক অথবা ইমেল ব্যবহার করুন।