ভূমিকা: আশরাফ ফায়াদ সৌদি আরব নিবাসী ফিলিস্তিনি কবি ও চিত্রকর। সৌদির চিত্রকলা আন্দোলনের অন্যতম সক্রিয় ব্যক্তিত্ব তিনি,জড়িত ছিলেন বৃটিশ-আরবীয় শিল্পী সংস্থা এজ অফ অ্যারাবিয়ার সাথেও। ফায়াদ ২০১৫ সালের নভেম্বরে সৌদি আদালত কর্তৃক মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত হয়েছেন- যে ঘটনায় সারা পৃথিবীর শিল্পজগত মুখর হয়ে উঠেছে সমালোচনায়।
২০১৩ সালে এক ফুটবল ম্যাচ চলাকালে সহশিল্পীদের সাথে তিনি বিতর্কে জড়িয়ে পড়েন,প্রথমবারের মত সৌদি পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে এক ব্যক্তির বিকৃত ও ভিত্তিহীন অভিযোগে- অভিযোগ ছিল যে ফায়াদের কবিতায় নাস্তিকতার উপাদান আছে। যদিও তিনি পরবর্তিতে জামিনে মুক্তি পান; ২০১৪তে আবার গ্রেফতার হন,আদালত তাকে ৪ বছরের জেল ও ৮০০ বেত্রাঘাতে দন্ডিত করে। পরবর্তিতে সৌদি আপিল কোর্ট তার কেসটির পুনরায় তদন্ত শুরু করে, নতুন বিচারক নিয়োগ করা হয়, নতুন বিচারক তার রায়ে দাবি করে যে ফায়াদ নাস্তিকতার প্রসার ঘটিয়েছেন তার ২০০৮ এ প্রকাশিত কবিতার বই ইনস্ট্রাকশনস উইদিনে, ফলত এ মিথ্যে দাবির ভিত্তিতেই তাকে মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়। ফায়াদ এমন কী কোন আইনজীবির সহায়তাও পাননি, যার ফলে তার কবিতার বইটির স্বপক্ষে তিনি যুক্তি দেখাতে পারতেন।
ফায়াদের পক্ষে তার সহশিল্পী, সাহিত্যিকেরা মনে করেন- এ মৃত্যুদন্ডের কারণ তার কবিতা নয় বরং সরকারি কট্টরপন্থিদের আক্রোশ; যে আক্রোশের শুরু হয় ভিডিও শেয়ারিং সাইটে তার আপলোডকৃত একটি ভিডিও থেকে, যেখানে দেখা যায়- আভা শহরের ধর্মীয় পুলিশ বাহিনী জনসমক্ষে এক লোককে বেত্রাঘাত করছে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক গবেষক এডাম কুগলের মতে- আশরাফ ফায়াদের মৃত্যুদন্ড এটাই প্রমাণ করে যে- কোন নাগরিক সৌদি আরবের সরকারি, সামাজিক, ধর্মীয় ও রাজনৈতিক মতামতের সমালোচনা করলে কোনভাবেই তারা সেটা মেনে নিতে প্রস্তুত নয়।
ইসলামি শরিয়াহ আইন নিজেদের খেয়াল খুশিমত ব্যাবহার করা আবার একই সাথে আমেরিকার অন্যতম ও দীর্ঘদিনের সহযোগি রাষ্ট্র হিসেবে ভূমিকা রাখা সৌদি সরকারের এহেন বিচার প্রশ্নবিদ্ধ ও সন্দেহসূচক। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠন ফায়াদের পক্ষে, তার মুক্তির দাবিতে আন্দোলন করছেন। ফায়াদ নিজেও বিবৃতি দিয়েছেন- তিনি কোন কিছুর বিপক্ষেই অবস্থান নেননি বরং একজন শিল্পী হিসেবে নিজের মত প্রকাশ করেছেন, এবং তিনি নিজের মুক্তির জন্য চেষ্টা করে যাবেন, যারা তার মুক্তির জন্য আন্দোলন করছেন ফায়াদ তাদের প্রতিও জানিয়েছেন কৃতজ্ঞতা।
এ অন্যায় দন্ডের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে হবে পৃথিবীর সকল শিল্পীকেই, মহাপথও এই বৈশ্বিক প্রতিবাদে সক্রিয় একাত্মতা পোষণ করে, দাবি জানায় অতিসত্বর আশরাফ ফায়াদকে অন্যায় মৃত্যুদন্ড থেকে মুক্তি দেয়া হোক। কবি কালপুরুষের ভাষান্তরে (মোনা করিমকৃত ইংরেজী অনুবাদ থেকে) আশরাফ ফায়াদের আলোচিত কিছু কবিতা রইলো মহাপথের এ বিশেষ আয়োজনে। হে পাঠক, শিল্প একটা আকাশ- শিল্পীর পায়ে শেকল দিলে সে আকাশ শুন্য আর ফাঁকা,বর্ণহীন হয়ে ওঠে- মেঘ, বর্ণ আর পক্ষিহীন আকাশ তো আদতে নিষ্প্রাণ প্রাচীরের মতই। -মহাপথিয় কেদারা
________________________
১
দারিদ্রের নিদর্শন রেখে যাওয়া ছাড়া খনিজ তেল তেমন কোনো ক্ষতি করে না
সেইদিন, যখন আর একটি তেলকূপ খুঁজে পেয়ে তাদের মুখ আঁধারে আচ্ছন্ন হয়েছিলো;
যখন জীবন, আপনার হৃদপিন্ডকে ক্লান্ত কোরে তুলেছিলো,
আপনার আত্মা হতে আরো বেশি তেল টেনে বের করার লক্ষ্যে,
জনগণের কল্যাণে…
সেটাই হলো তেলের প্রতিশ্রুতি, একটি প্রকৃত প্রতিশ্রুতি…
এবং শেষ।
২
বলা হয়েছিলো: বসতি স্থাপন করুন
কিন্তু আপনাদের মধ্যে কেউ কেউ আছেন যারা সকলের জন্য ক্ষতিকর
সুতরাং এটা স্থগিত থাক
নদীর সর্বোচ্চ গভীর হতে নিজেদের দিকে তাকিয়ে দেখুন
যারা উপরে অবস্থান করছেন, তাদের উচিৎ কিছু করুণা প্রদর্শন করা নিচে অবস্থানকারীদের প্রতি
গৃহচ্যুত মানুষেরা খুব অসহায়
এতটাই যে, তেলের বাজারে এদের রক্তেরও কোনো মূল্য নেই!
৩
ক্ষমা করো, ক্ষমা করো আমাকে
তোমার জন্য আরো বেশি কান্না প্রকাশ না করতে পারার কারণে
এবং স্মৃতিকাতরতার মধ্যে অস্ফুটস্বরেও আমি উচ্চারণ করতে পারিনি তোমার নাম
অথচ আমি প্রতীক্ষা কোরে ছিলাম তোমার উষ্ণ আলিঙ্গনের জন্য
তুমি ছাড়া আমার কোনো ভালোবাসা নেই, একমাত্র তুমি, আর আমিই সে—
তোমার প্রথম অনুসন্ধানকারী
৪
রাত্রি,
সময় প্রসঙ্গে তুমি অভিজ্ঞ নও;
আর সেই বৃষ্টিরও অভাব
যা মুছে দিতে পারতো তোমার অতীতের সকল দুঃখ
এবং তোমাকে মুক্তি দিতে পারতো সেই বন্দীত্ব থেকে, যার নাম দেয়া হয়েছে ধর্মপ্রেম—
ভালোবাসতে সক্ষম তোমার সেই হৃদয়ের সন্দেহপ্রবণ বিশ্বাস থেকে
এবং পৃথক করতে পারতো অস্পষ্ট ধর্ম থেকে তোমার অবৈধ প্রত্যাহার
সেই কপট দৈব নির্দেশ আর
সেই ঈশ্বরদের থেকে
যারা ইতিমধ্যে তাদের গৌরব হারিয়েছেন
৫
তুমি ঢেঁকুর তুলছো, তোমার শক্তির চেয়ে অধিক পরিমাণে
মদের দোকানগুলো যেভাবে তাদের খরিদ্দারদের মহিমান্বিত করে তোলে
আবৃত্তি আর সম্মোহনী নর্তকীদের দ্বারা
ডিজেকে সঙ্গে নিয়ে
তুমি আবৃত্তি করে চলেছো তোমার অলৌকিক বিশ্বাসসমূহকে
এবং ছুড়ে দিচ্ছো প্রশংসা এই সব নর্তকীদের দিকে
যারা নির্বাসিত কবিতার সাথেও তাদের শরীরকে দোলাচ্ছে
৬
তার অধিকার নেই হাঁটার,
আন্দোলিত হওয়া কিংবা কাঁদারও অধিকার পায়নি সে
আত্মার জানালা খোলার কোনো অধিকার তার নেই;
যা তার নিঃশ্বাস, তার ধ্বংস এবং তার চোখের জলকে
পুনরায় শুদ্ধ কোরে তুলতে পারে
তবু তুমি ভুলে যেতে চাও যে,
এক টুকরো রুটি ছাড়া তুমি আর কিছুই নও
৭
নির্বাসনের দিনটিতে, তারা নগ্ন দাঁড়িয়ে ছিলো;
যখন তুমি নর্দমার ময়লার জলের মধ্যে সাতার কাটছিলে, নগ্ন পায়ে…
হতে পারে সেটা তোমার পা’য়ের স্বাস্থ্যের পক্ষে ভালো
কিন্তু পৃথিবীর জন্য নয়
৮
ধর্মপ্রবক্তারা অবসরে গিয়েছেন
সুতরাং তারা তোমার কাছে ফিরে আসবে— এই প্রতীক্ষা অর্থহীন
এবং তোমার জন্য,
শুধু তোমার জন্য উপদেষ্টারা নিয়ে আসে তাদের দৈনন্দিন রিপোর্ট
এবং ভালো মূল্যও পায়
একটি মর্যাদাপূর্ণ জীবনের জন্য
তুমি তো জানো, টাকা কত গুরুত্বপূর্ণ!
৯
আমার পিতামহ প্রতিদিন নগ্ন হয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন,
নির্বাসনহীন, স্বর্গীয় কোনো অবদান ছাড়াই…
আত্মায় কোনো অলৌকিক আঘাত ছাড়াই ইতিমধ্যে নিজেকে একবার পুনরুজ্জীবিত করেছি;
পৃথিবীতেই পেয়ে চলেছি নরকের প্রকৃত অভিজ্ঞতা
কারণ পৃথিবীই হচ্ছে সেই নরক যা শরণার্থীদের জন্য তৈরি
১০
তোমার মূক রক্ত কোনো কথা বলবে না
যতদিন তুমি তোমার মৃত্যুতে গর্ব অনুভব করবে
যতদিন তুমি তোমার সিদ্ধান্তে গোপনে স্থির থাকবে,
তোমার আত্মাকে সেইসব হাতে তুলে দিতে
যারা আসলে কিছুই জানে না
আত্মা হারানোর মূল্য তোমাকে সময় দিয়ে পরিশোধ করতে হবে
একটি চোখ শান্ত হতে যে সময় লাগে, তার চেয়েও দীর্ঘ সে সময়;
তোমার যে চোখ হতে অশ্রু নয় ঝরে পড়ে তেল
________________
কালপুরুষ: কবি। প্রকাশিত কবিতার বই এই শহরে রাজহাঁস নিষিদ্ধ (২০১৫)। ২য় কবিতার বই রোহিণীর জন্য একটি রাষ্ট্র প্রকাশিতব্য।
অসাধারণ বললে কেমন যেন নষ্ট হয়ে যায় আবেগ।আমি অত্যন্ত অর্বাচিন,এই কবিতাগুলো পরিনি।আমাকে অনুগ্রহ করে প্রকাশনার নাম বলুন
LikeLiked by 1 person
মতামতের জন্য ধন্যবাদ জানবেন।
LikeLike