প্রবন্ধ / বই আলোচনা

প্রদোষে প্রাকৃতজন; ইতিহাসে প্রাকৃতজন ও শিল্পীর অমিমাংসিত সত্য।।তাবাসসুম জাফরী

অলংকরণ- মহাপথিয় কেদারা

অলংকরণ- মহাপথিয় কেদারা

‘ইতিহাস হচ্ছে সত্য ঘটনার বিবরণ আর ইতিহাস আশ্রিত সাহিত্য হচ্ছে ইতিহাসের কংকালের ওপর কবি কল্পনার ঐশ্বর্য’
(Aristotle: On The Art Of Poetry, Classical literary Criticism Translated by T.S.Dorsch)

সময়ের শক্তিশালী কথাসাহিত্যিক শওকত আলী (১৯৩৬) তাঁর ‘প্রদোষে প্রাকৃতজন’ (১৯৮৪) উপন্যাসটিতে যেনো ইতিহাসের শরীরে কল্পনার চমৎকার দৃশ্যায়নে এমনই একটি পটভূমিকায় প্রায় আটশত বছর পূর্বে রাজা লক্ষণ সেনের রাজত্বকালে সামন্ত-মহাসামন্তদের দ্বারা প্রাকৃতজনদের অত্যাচারিত জীবন-চিত্রের কাছে আমাদের নিয়ে যান।
‘তবে এই কল্পনায় নেই মনগড়া ইতিহাস বরং আছে ইতিহাসের মনোময় বিন্যাস। এই উপন্যাসে ইতিহাসের উপাদান পরিনত হয়েছে শিল্পে এবং এক্ষেত্রে লেখকের সাফল্য অনতিক্রান্ত’ (বাংলাদেশের সাহিত্য, বিশ্বজিৎ ঘোষ, পৃষ্ঠাঃ ১৩২-১৩৩)

দুই পর্বের উপন্যাস ‘প্রদোষে প্রাকৃতজন’ রচনার জন্য শওকত আলী ইতিহাসের একটি বিশেষ সময় সন্ধিক্ষণকে বেছে নিয়েছিলেন। ইতিহাসের তিনটি ঘটনাক্রম তখন একই জায়গায় মিলিত হয়েছিল।
১। তুর্কিদের গৌড় ও বঙ্গ বিজয়ের অভিযান
২। তৎকালীন বৌদ্ধধর্মীদের সঙ্গে সনাতন ও ব্রাহ্মণ্য হিন্দুদের বিরোধ
৩। লক্ষণ সেনের শাসনামলের শেষদিকে সামন্ত মহা-সামন্তদের প্রবল নিপীড়নের মুখে পড়া প্রাকৃত মানুষের অস্তিত্ব ও আবির্ভাবের সংবাদ।

উপন্যাসে চিত্রায়িত প্রাকৃত জীবনের সমগ্র দৃষ্টিকোণ আমাদের জানায় মূলত একটি নির্বিবাদ নিরাপদ প্রত্যূষের জন্য শ্যামাঙ্গ, বসন্ত, মায়াবতী, লীলাবতীদের অতিক্রম করতে হয়েছিলো দুঃখের দীর্ঘ রাত, সভ্যতার আদি হতে যে পথ সমস্ত প্রাকৃতজনেরা কেবলই অতিক্রম করে চলেছে এবং যার শেষ কোথায় কেউ জানেনা। তাঁদের কণ্ঠে তাই উচ্চারিত হয়,

‘এই কি মানুষের জীবন? সুখ নেই, স্বস্তি নেই, গৃহ নেই, কেবলই প্রাণ নিয়ে পলায়ন করতে হচ্ছে- এর শেষ কোথায়? এ জীবন কি যাপন করা যায়? বলো কতদিন এভাবে চলবে?’

এই পথ চলতে গিয়ে প্রাকৃতজনেরা প্রতিরোধ করতে চায়, চায় মাথা উঁচু করে তাঁদের উত্থান হোক। বসন্তদাস তাই ভাবে,
‘ভাবো তো যদি সকল প্রাকৃতজন একত্রে প্রতিরোধ করে তাহলে কী হতে পারে? যুগ যুগ ধরে প্রাকৃতজন এভাবেই প্রতিরোধ করে। লাঞ্ছিত হয়, নিহত হয়, ধ্বংস হয়ে যায়, কিন্তু তথাপি ঐ একই সঙ্গে সে প্রতিরোধ করতে ভোলে না- হয়তো বিচ্ছিন্ন, হয়তো একাকী এবং শস্ত্রবিহীন- তথাপি তাঁর দিক থেকে প্রতিরোধ থেকেই যায়।

Shawkat Ali's Interview BBC Bangla

শওকত আলীর অডিও সাক্ষাৎকার শুনতে ছবিতে ক্লিক করুন।

*******
ইতিহাস ও উপন্যাসকে একত্রিত করতে গিয়ে লেখক তুলে এনেছেন সময়ের মূল প্রবণতা এবং ইতিহাসের মৌল সত্য। রাজশক্তি কেবল প্রজা পীড়নের জন্যই ব্যবহৃত হওয়ার কারণে বহির্শত্রুদের আক্রমণের আগেই ভঙ্গুর এবং অন্তঃসারশূন্য হয়ে পড়েছে প্রাকৃত সমাজ। বসন্তদাসের চোখ দিয়ে লেখক আমাদের জানাচ্ছেন,

‘পথে দস্যু যা হস্তগত করে সে আর কতটুকু। পক্ষান্তরে যুগ যুগ ধরে নিজগৃহেই অপহৃত হয়ে চলেছে তারা। গ্রামপতি নেয়, রাজপুরুষেরা নেয়, ব্রাহ্মণেরা নেয়, কায়স্থরা নেয়- কে তাঁদের শ্রমলব্ধ উপার্জনের অংশ নেয় না? প্রাকৃত মানুষের লুণ্ঠনের ওপর সমাজের যে সৌধ দাঁড়িয়ে আছে, গৌড় বঙ্গের রাজধানী লক্ষণাবতীতে যা শীর্ষে অবস্থান করছেন লক্ষণ সেন তা সভাকবিদের উচ্ছ্বাসে কামকলানিপুণা নারীদের রম্যলীলায়, স্মার্ত পণ্ডিতের ভাবগত বিশ্লেষণে চমৎকার রূপ ধারণ করেছে।’

অন্যদিকে শ্যামাঙ্গ দেখছে ‘কেবল ব্রাত্য শূদ্রদের গৃহেই অন্ন নেই, দেহে বস্ত্র নেই, মস্তকোপরি গৃহের আচ্ছাদন থাকে না। তথাপি আজ যদি গ্রামপতি বসবাসের স্থান দিলেন তো কালই বলবেন, দূর হ পামরের দল’

প্রাকৃতজনের এই সামাজিক দুঃখ দুর্দশাময় লাঞ্ছিত অবস্থান ইতিহাস স্বীকৃত। কালীপ্রসন্নরায়ের ‘মধ্যযুগের বাংলা’ থেকে আমরা জানতে পারি—

‘সোনার বাংলা ভদ্র গৃহস্থদের, সাধারণ মানুষের নয়। সেকালে অবশ্যই টাকায় পাঁচ মণ ধান বিক্রি হতো, কিন্তু সেই সঙ্গে এই সত্য না জানলে তার যথার্থ রূপ উপলব্ধি করা যাবে না যে, সাধারণ শ্রমজীবীর মজুরী ছিলো চার পয়সারও কম।’

ব্রাত্য ও প্রাকৃতজনদের নিজেদের অস্তিত্ব আবিষ্কার করবার এই যে আকাঙ্ক্ষা সেটাই আটশত বছর আগে বাংলায় প্রচারিত মানবতাবাদকে আহবান ও প্রতিষ্ঠিত করেছে। অরবিন্দ পোদ্দারের ভাষ্যে আমরা ইতিহাসের সেই সঙ্কুল সময়টাকেই যেনো দেখি, যখন বর্ণসংস্কারে জর্জরিত ভারতবর্ষে, বঙ্গ সমতটে ইসলামের পরিধির বাইরের মানুষের কাছে সামাজিক সমানাধিকারের মানবিক আদর্শই বড় আকর্ষণ ও প্রলোভন হিসেবে কাজ করেছে।

সমাজপতিদের ইচ্ছায় প্রাকৃত মানুষদেরকে তাঁদের সমস্ত মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত রাখা হয়েছিল। তাঁদেরকে দৈব ও ভাগ্য নির্ভর বলে এবং তাঁদের এই অবস্থা তাঁদেরই কর্মফল বলে চিরকাল তাঁদেরকে দাবিয়ে রেখেছে সামন্তপতিরা। ভিক্ষু মিত্রানন্দের বসন্তদাসকে করা কয়েকটি মৌলিক প্রশ্নই যেনো আমাদেরকে দাঁড় করিয়ে দেয় প্রাকৃতজনদের মূল অবস্থানের সামনে। সে জিজ্ঞাসা করেঃ

‘নিজের জীবনের কথা কখনও ভেবেছেন? আপনি কি পুরুষানুক্রমে দাস? সামন্তপতির দাস? কায়স্থের দাস? আপনার কি ভগবান আছেন? বলুন আছেন? আপনি ভগবানের পূজা করতে পারেন? নিন্মশূদ্রে কত বর্ণ ভেবে দেখেছেন? শ্রেণিতে বিভেদ, একে অপরের লাঞ্ছনা করে, শোষণ করে, লুণ্ঠন করে। আপনি কি লুণ্ঠিত হননি বলুন?’
‘ব্রাহ্মণ হয়েও যে হত্যা লুণ্ঠন ও লাম্পট্যে নিয়োজিত সে কেন ঐ মর্যাদা পাবে? আপনি পুরুষানুক্রমে সৎ জীবন-যাপন করলেও ব্রাহ্মণ হতে পারবেন না…।’

এমনই অনেক প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে বসন্তদাস নিজের অসন্তুষ্টির কথা জানায়। মূলত তাঁর এই রূপান্তরের পেছনে এক মুসলমান বণিকের সাহচর্যের কথা উল্লেখ রয়েছে। বৃদ্ধের কথায় তাঁর অনেক ভুল ধারনাও অপসৃত হয়েছে। নতুন সমাজে জাতিভেদ থাকবেনা এবং সমতা ও মানবতাবাদই যে তাঁকে আকৃষ্ট করেছে তা বলাই বাহুল্য। তবে সে জানতে চায় প্রচলিত ব্যবস্থা ভেঙে গেলে সে আসলে কী পাবে। ব্রাত্য ও প্রাকৃতজনদের নিজেদের অস্তিত্ব আবিষ্কার করবার এই যে আকাঙ্ক্ষা সেটাই আটশত বছর আগে বাংলায় প্রচারিত মানবতাবাদকে আহবান ও প্রতিষ্ঠিত করেছে। অরবিন্দ পোদ্দারের ভাষ্যে আমরা ইতিহাসের সেই সঙ্কুল সময়টাকেই যেনো দেখি, যখন বর্ণসংস্কারে জর্জরিত ভারতবর্ষে, বঙ্গ সমতটে ইসলামের পরিধির বাইরের মানুষের কাছে সামাজিক সমানাধিকারের মানবিক আদর্শই বড় আকর্ষণ ও প্রলোভন হিসেবে কাজ করেছে। তিনি বলেন, ‘হিন্দু সামাজিক সংস্থার নির্মম বিধানে যারা নির্যাতিত হচ্ছিলো বর্ণ সমাজের অন্তর্গত নিম্ন বর্ণ এবং বর্ণ সমাজের বাইরের অস্পৃশ্য জাতিগুলি— তারা ইসলামিক সমাজ সংস্থায় আশ্রয় গ্রহণ করে সামাজিক নির্যাতন থেকে মুক্তি লাভ করেছে। হিন্দু সমাজের বিধানদাতাদের নিকট যারা ছিলো শূদ্র এবং অস্পৃশ্য পর্যায়ের, ইসলাম তাঁদের দিল মুক্ত মানুষের অধিকার… ’

প্রদোষে প্রাকৃতজনের প্রচ্ছদ

প্রদোষে প্রাকৃতজনের প্রচ্ছদ

ইতিহাসের সেই সময়কে বোঝার জন্য নাগেন্দ্রনাথ বসুর একটি উদ্ধৃতি এক্ষেত্রে উল্লেখের প্রয়োজন মনে করছি।
‘মুসলিম সংস্পর্শে আসার পর উত্তর ভারতের মতো বাংলার হিন্দু সমাজেও ভাঙন ধরে। মুসলিম সমাজের সাম্য, ভ্রাতৃত্ব ও পেশা গ্রহণের স্বাধীনতা এবং কর্মসূত্রে ভাগ্য পরিবর্তনের অবাধ সুযোগ প্রভৃতি দেখে নিম্নশ্রেণীর হিন্দুমন বিচলিত হয়ে ওঠে। বাংলায় ও বিহারে নিম্ন শ্রেণীর হিন্দুরা ইসলামের প্রচ্ছায় জীবনের নতুন দিগন্ত দেখতে পেল’ (বাঙ্গালার জাতীয় ইতিহাস ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠাঃ ১৮৪)

মানবিক এই স্বীকৃতিতে উদ্বুদ্ধ প্রাকৃতজনদের প্রতিনিধির অন্য উদাহরণরূপে উপন্যাসে উঠে এসেছে লীলাবতী। আগুন্তুক ধর্মে সে পেয়েছিল তাঁর অত্যাচারিত নিগৃহীত জীবন থেকে বন্ধন মুক্তির সংবাদ।
উপন্যাসের দুটি প্রধান চরিত্র শ্যামাঙ্গ ও বসন্তদাস প্রাকৃত জীবনেরই দুই প্রতিনিধি। উপন্যাস ও ইতিহাস এই দুইয়ের সংমিশ্রণে গঠিত হয়েছে তাঁদের সামাজিক পরিমণ্ডল। আত্রেয়ী তীরের রজতপীট গ্রামের মৃৎ-শিল্পী শ্যামাঙ্গ মায়াবতীদের বাড়ীতে আশ্রয় নিলেও তাঁর প্রতি উত্থাপিত হয় মানুষের চিরন্তন সামাজিক জিজ্ঞাসা।
অন্যদিকে ব্যাক্তি বসন্তদাস-ও নিভৃত জীবন থেকে ছিটকে পড়ে সামাজিক বহির্মণ্ডলে, যেখানে ব্যাক্তি নিজেই নিরাপদ নয়। সামন্ত হরিসেনের অনুচরদের দ্বারা তাঁর যে নিরাপত্তাহীন অবস্থা হয় সেটা আটশত বছর পরেও বিংশ শতাব্দীতে এসে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সৃষ্ট চরিত্রের না জেনে পানের ঠোঙায় রাজনৈতিক ইশতেহার বহন করা এবং রাজশক্তির কোপানলে পড়ে বিচ্ছিন্ন জীবন যাপন করা যেনো আমাদের প্রাকৃত জীবনের চিরায়ত ধৃতরূপকেই বাহিত করে দেখায়।

সামাজিক বিকাশের সমস্ত পথ রুদ্ধ হবার ফলে যে শূন্যতার সৃষ্টি হয় সেখানে ইসলাম তাঁর অধিকতর প্রাগ্রসর ভূমিকায় প্রতিষ্ঠিত হয়। তাঁদের জীবন পরিস্থিতি নিয়ে যায় এক দ্বান্দ্বিক বাস্তবতায়, যেখানে তাঁরা নিজেরাও জানেনি তাঁদের পরিণতি কি হতে পারে। লেখক যবনদের প্রতিষ্ঠার এই বিষয়টিকে বস্তুগত দৃষ্টিকোণ থেকেই বিচার করেছেন, তাই লক্ষণ সেনের সভাসদ হলায়ুধ মিশ্রের জবানে উচ্চারিত হয় অন্য সত্য।

‘যবনরা যদি আসে তখনও দেখতে পাবে তাদের উচ্চশ্রেণীর লোকেরা সদ্ভাব করছে আমাদের উচ্চশ্রেণীর লোকদের সঙ্গে। নীচ যে সে সর্ব অবস্থায় নীচই থাকবে।’

তাই উপন্যাসের শেষে সেনাপতি কাফুর খানের সঙ্গেই সামন্তপতিদের মিত্রতা গড়ে ওঠে।
ঐতিহাসিক সেই সময়ের বর্ণনায় লেখক সত্য অনুসন্ধানী হতে চেয়েছেন বার বার। আনিসুজ্জামান ‘প্রদোষে প্রাকৃতজনের’ ফ্ল্যাপে একথাটিই বলেছেন এভাবে–

‘গবেষণার সঙ্গে এই বইতে যুক্ত হয়েছে দরদ, তথ্যের সঙ্গে মিলেছে অন্তরদৃষ্টি, মনোহর ভঙ্গির সঙ্গে মিলেছে অনুপম ভাষা।’

*****
‘প্রদোষে প্রাকৃতজন’ উপন্যাসের অন্যতম মূল একটি বিষয় যা আমাকে প্রবলভাবে আলোড়িত করেছে তা হলো এই যে, প্রাকৃত মৃৎশিল্পী শ্যামাঙ্গের বিকাশ ও পরিণতি রূপায়নের মাধ্যমে একজন শিল্পীর সাংস্কৃতিক বিকাশের ধারা যে কতটা রুদ্ধ ছিলো এবং সেই পরিস্থিতি যে এখনও বর্তমান তা-ই প্রকাশ করেছেন লেখক। লক্ষণ সেনের সময়ে যখন মৃৎশিল্পের কাজ প্রায় অবলুপ্ত তখন তাঁর গুরু বসুদেব তাঁকে বিল্বগ্রামে সুধীমিত্রের ইচ্ছায় মৃৎফলক বানানোর কাজে ডেকে নেন।
দেবতার রূপ নয়, শ্যামাঙ্গ সেখানে স্বাধীনভাবে ব্রাত্য জীবনকেই তুলে এনেছিল। আর তখন সেখানেই শিল্পের ওপর যুগ যুগ ধরে খড়গহস্ত রাজশক্তির উপস্থিতি। একজন শিল্পীকে নিয়ন্ত্রণের প্রবল চেষ্টা, যা অনেকসময়ই আর্থিক সঙ্গতির দূর্বলতাকে নির্দেশ করেই এগিয়ে যায়। বসুদেবের মুখে উচ্চারিত হয়—

‘তুমি…তাঁর… আদেশের দাসমাত্র। তাঁর আদেশ পালনের জন্যেই তোমাকে অর্থ দেয়া হচ্ছে…’

এভাবেই সময়ে সময়ে ক্ষমতাসীনদের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ ও বাঁধাপ্রাপ্ত হয়েছে শিল্পের স্বাধীনতা ও ব্যাক্তিক চেতনা। কিন্তু শ্যামাঙ্গ, যার শিল্পদৃষ্টি ও ব্যাক্তিক মনোভাব কখনও পরাজয় মানেনি, সে ভাবে—

‘শিল্পী কি ক্রীতদাস? রাজানুগ্রহ ব্যতিরেকে কি শিল্পীর অস্তিত্ব নেই?… প্রথা ও অনুশাসন ছিন্ন করেন যে শিল্পী তিনি কি ক্রীতদাস হতে পারেন?’

সে দৃঢ়তা নিয়ে গুরু বসুদেবকে শিল্পের ব্যাখ্যা করে… ‘গৌড়ীয় রীতি কোন রীতি নয় এ হলো রীতি ভঙ্গের রীতি- জগতের সত্য রূপটি, শাশ্বত রূপটি যে রীতিতে ধারণ করা যায় সেটিই গৌড়ীয় রীতি।’
শেষ পর্যন্ত গুরু বসুদেব নিজের অক্ষমতার কথা প্রকাশ করেন। এবং বলেন,

‘তুই না যুবা-পুরুষ? তোর শক্তি রয়েছে অসীম—তুই কেনো ক্রিপা ভিক্ষা করতে চাস? শিল্প রচনা কি অপরের মুখাপেক্ষী থাকে? জানিস না শিল্প রচনা কি বস্তু?… এখানে তোমার স্থান নেই শ্যামাঙ্গ…’

আজ থেকে আটশত বছর আগের সেই শিল্প-বাস্তবতা আমাদের সমকালেও  স্বরূপে উপস্থিত, এখানেই এই উপন্যাস কালোত্তীর্ণ।
শিল্পী শ্যামাঙ্গ অবশেষে ছেড়ে দিয়েছিল তাঁর শিল্পের সাধনা, তবু তাঁর মৃত্যুর পর কি সত্যিই শিল্পের মৃত্যু হয়েছিলো? ঔপন্যাসিক আমাদের জানান শ্যামাঙ্গর
‘দৈহিক মৃত্যু হলেও প্রকৃত মৃত্যু হয়নি। তাঁর সমস্ত জীবনোপলব্ধি বীজের মতো প্রোথিত ছিলো অনন্ত জন্মধারাবাহী প্রাকৃতজনের নিত্যসংগ্রামী জীবনবৃত্তের মধ্যে।’

তাই কয়েক শতাব্দী পর শ্যামাঙ্গ ফিরে আসে পুনর্ভবার তীরে… জেগে থাকে তাঁর চিরন্তন শিল্প এবং শিল্পসত্তা।

****

ঔপোন্যাসিক শওকত আলী

ঔপোন্যাসিক শওকত আলী

ত্রয়োদশ শতাব্দীর পটভূমিতে লেখা সন্ধ্যায় উপনীত প্রাকৃতজনদের শেষ পরিণতি কি হয়েছিলো? না, শওকত আলী তাঁদের পরিণতি লিপিবদ্ধ করেননি। ঘর বাঁধতে পারেনি শ্যামাঙ্গ-লীলাবতী। কারণ শ্যামাঙ্গ গ্রহণ করতে পারেনি যবন ধর্ম। সমাজকাঠামোর নিজস্ব অন্তঃসারশূন্যতা ও স্খলিত রাষ্ট্রশক্তির ঐ বিভীষিকাময় সময়ে প্রাকৃতজনদের মধ্যে যে দ্বান্দ্বিক মনস্তত্ব কাজ করেছে শ্যামাঙ্গ সেখানে স্বাধীন প্রতিনিধি। লীলাবতীকে সে বোঝাতে চায়–

‘আমরা এই মৃত্তিকার সন্তান, বহুযুগ ধরে পুরুষানুক্রমে আমরা ধর্ম পালন করে আসছি। আমাদের চিন্তা ভাবনা আনন্দ শোক আবেগ কল্পনা সমস্তই যেমন আমাদের ধর্মাশ্রয়ী তেমনি মৃত্তিকাশ্রয়ী। এ ধর্ম ত্যাগ করার অর্থ নিজেকেই ত্যাগ করা—এ অসম্ভব ব্যাপার, তুমি ঐ চিন্তা করো না।’

কিন্তু লীলাবতী মুক্তি চায়, জীবন চায়, সংসার এবং সন্তানের স্বপ্ন দেখে। তারপর? লেখক নিজেই দেন এর জবানবন্দী—

‘সীমাবদ্ধ ক্ষমতাই লেখককে অধিক বিস্তারে যেতে সাহসী করেনি। উপরন্তু ঐসব চরিত্রের পরিণতি ইতিহাসে মোটামোটি স্পষ্টভাবে লিপিবদ্ধ।’

বিষয়টির নিষ্পত্তি না করেই বরং পাঠকের জন্য তিনি জাগিয়ে তুলেছেন পরবর্তী পরিস্থিতি নিয়ে আরেকটি ঐতিহাসিক উপন্যাসের অমিত সম্ভাবনা… যে অন্ধকার, যে হত্যা ও মানুষে মানুষে মমতাহীনতা বয়ে চলেছে নির্মমভাবে যুগ যুগ ধরে প্রাকৃতজনের জীবন-সন্ধ্যায়, তাঁর পরিণতি কেই বা দিতে পারে!
__________________

লেখিকা: তাবাসসুম জাফরী। কবিতা, গল্প ও প্রবন্ধ লিখছেন বিভিন্ন মাধ্যমে। শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত। 

2 thoughts on “প্রদোষে প্রাকৃতজন; ইতিহাসে প্রাকৃতজন ও শিল্পীর অমিমাংসিত সত্য।।তাবাসসুম জাফরী

  1. Pingback: নভেম্বর ২০১৫ সংখ্যা | মহাপথ

  2. Pingback: মহাপথ নভেম্বর ২০১৫ সংখ্যা | মহাপথ

লেখা সম্পর্কে মতামত জানাতে ফেসবুক অথবা ইমেল ব্যবহার করুন।