প্রবন্ধ

বিট জেনারেশন নিয়ে কিছু কথা।।বনী ইসরাইল

বিট প্রজন্ম কেবলমাত্র আমেরিকা কিংবা ইউরোপে নয়, বিগত শতকের পঞ্চাশের দশকে এই সাংস্কৃতিক বিস্ফোরক প্রভাব ফেলেছিল সারা পৃথিবীতেই। মহাপথের এ সংখ্যায় তাদের নিয়ে কিছু প্রাথমিক আলাপ করেছেন বনী ইসরাইল। এ রচনা থেকে মিলে যাবে বিটদের পরিচিতিমূলক ফেস্টুন।

Georges-Mathieu-First-Avenue-Rounded

বিট জেনারেশন একটি ব্যাপক জনপ্রিয় নাম আজকের দুনিয়ায়। অনেক আলোচনা সমালোচনা হচ্ছে তাদের উদ্ভট কাজ নিয়ে। বিট জেনারেশনের সূচনাটা হয় আমেরিকায়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী অস্থির সময়ে। এ গ্রুপ ১৯৫০ এর দিকে তুমুল জনপ্রিয়তা পায় তাদের বিচিত্র কর্মকাণ্ড এবং সাহিত্য প্রতিভার কারণে। বিট জেনারেশনের মূল আকর্ষণ ছিল প্রচলিত সমাজ প্রদত্ত মানদণ্ড প্রকাশ্যে অস্বীকার। নতুন একটি ধারা চালু করাই ছিল তাদের লক্ষ্য। সবচেয়ে বেশি সমালোচিত ছিল ড্রাগ নিয়ে তাদের বাড়াবাড়ি, প্রাচ্যধর্মের প্রতি ব্যাপক আগ্রহ, তারা প্রত্যাখ্যান করেছিল বস্তুবাদ। বিট জেনারেশনর প্রভাব পরবর্তীতে উপমহাদেশের সাহিত্যে এসেছিল। হাংরি আন্দোলন তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ।

ঔপোন্যাসিক জ্যাক কেরুয়াক “বিট জেনারেশন” নামটি প্রথম ব্যবহার করেন নিউইয়র্কে, গতানুগতিকতা বিরোধী তরুণদের গুপ্ত আন্দোলনকে বিশেষভাবে সংজ্ঞায়িত করতে। নামটি উঠে আসে যখন কেরুয়াক ব্যাস্ত ছিলেন লেখক জন কেলন হোমসের সাথে কথোপকথনে। কেরুয়াক স্বীকার করেন যে এই শব্দটি রাস্তার গুন্ডা হারবার্ট হাংকি ব্যবহার করত কিন্তু এই শব্দটার মানে এই নয় যে ক্লান্তি বা পতিত হওয়া। তার বদলে কেরুয়াক শব্দটাকে অন্য মাত্রা প্রদান করেন। তিনি এটিকে ব্যাবহার করেন সঙ্গীতের উচ্চমাত্রার স্বর্গীয় সুখ কিংবা সঙ্গীতের সাথে থাকা বুঝাতে।

বিট জেনারেশন সৃষ্টি হয় ইউনিভার্সিটি অফ কলম্বিয়ায় যখন কেরুয়াক, অ্যালান গিন্সবার্গ, লুসিয়ান কার, হলচেস এবং অন্যান্যরা মিলিত হন একসাথে। জ্যাক কেরুয়াক কলম্বিয়াতে আসেন ফুটবল স্কলারশিপ নিয়ে যদিও বিটরা বিবেচিত হতেন প্রতিষ্ঠান বিরোধী রূপে। তাদের বেশিরভাগ চিন্তা ভাবনা রুপ নেয় প্রফেসর লিওনেল থ্রিলিন এবং মার্ক ভ্যান ডরেন এর প্রতিউত্তরে। সহপাঠী কার এবং গিন্সবার্গ আলোচনা করেন একটি নতুন দৃষ্টি ভঙ্গির যা প্রতিহত করবে প্রফেসরদের রক্ষণশীল জ্ঞানকে।

বিট জেনারেশনের একজন মূল্যবান কবি হলেন বব কাউফম্যান। তিনি মূলত একজন কৃষ্ণাঙ্গ কবি। আধ্যাত্মিকতা চর্চা করতেন যার ফলে তিনি বস্তুবাদকে অস্বীকার করেন। তার কবিতা ছিল মূলত রাজনৈতিক সংলাপ মুখর। ব্যাগল শপ নামক একটি জায়গায় তিনি কবিতা পাঠ করতেন। তিনি যখন কবিতা পাঠ করতেন শ্রোতারা নিশ্চুপ হয়ে শুনত। ৬০’র দশকে তিনি মাদকাসক্ত হয়ে নিউ ইয়র্ক এর একটি হাসপাতালে ভর্তি হন।

উইলিয়াম সেওয়ার্ড বারোজের দুর্বলতা ছিল অপরাধ প্রবণতায়। তিনি জড়িয়ে পড়েন চোরাই জিনিস এবং মাদক বেচাকেনায় ফলতঃ দ্রুতই আক্রান্ত হয়ে পড়েন মাদকে। হারবার্ট হাংকের সাথে আন্ডার গ্রাউন্ড অপরাধীদের মাঝে মিশে যান। হাংক বাকি বিট সদস্যদের নিয়ে আসেন সেখানে, যিনি পরবর্তীতে লিখতেও শুরু করেন।

এ্যালেন গিন্সবার্গ গ্রেপ্তার হন ১৯৪৯ সালে। পুলিশ গিন্সবার্গকে ধরতে চেষ্টা করে যখন তিনি গাড়ি চালাচ্ছিলেন হাংকের সাথে। তার গাড়ি ভর্তি ছিল চোরাই মালে। যখন তিনি পালাতে চেষ্টা করছিলেন তার গাড়ি দুর্ঘটনায় আক্রান্ত হয়, তবে তিনি পালাতে সক্ষম হলেও কিন্তু পেছনে ফেলে যান তার নোট বুক। তাকে সুযোগ দেওয়া হয়েছিল অপরাধ স্বীকার করে নব্বই দিন বেলিভিউ হাসপাতেলে স্বেচ্ছা সেবা প্রদান করতে। যেখানে তিনি পরিচিত হন কার্ল সোলেমন এর সাথে। সোলেমন ছিল আরো বেশি খ্যাপাটে ও উন্মাদ স্বভাবের। তিনি নিজেকে সমর্পণ করেছিলেন পাগলামিতে। সোলেমনকে শক ট্রিটমেন্ট দেওয়া হত বেলিভিউ হাসপাতেলে যা ছিল গিন্সবার্গের “ হাওল” এর মুল থিম। কবিতাটি গিন্সবার্গ সোলেমনকে উৎসর্গ করেছিলেন।

1951 beat Generation

বারোজকে বিট দলে প্রথম পরিচয় করিয়ে দেন কেরুয়াক, যে লুসিয়ান কারের প্রেমে পড়ে। লুসিয়ান কার বন্ধুত্ব করেন গিন্সবার্গ ও বারোজের সাথে। কার চিনতেন কেরুয়াকের প্রেমিকাকে যার নাম ছিল এ ডি পার্কার। ১৩ই আগস্ট ১৯৪৪ এ, লুসিয়ান কার ক্যামেরারকে খুন করেন রিভার সাইড পার্কে। পরবর্তীতে এটা প্রকাশ পায় যে আত্মরক্ষার জন্য তিনি হত্যা করেন। পরে হাডসন নদীতে ফেলে দেন লাশ। হত্যাকান্ডের পর তিনি কেরুয়াকের কাছে যান, কেরুয়াক তাকে অস্ত্র গোপন করতে সাহায্য করেন। লুসিয়ান কার মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্বে দিশেহারা হয়ে হত্যা স্বীকার করেন, কেরুয়াকের বিরুদ্ধে চার্জ আনা হয় হত্যা সাহায্যকারী হিসাবে। কেরুয়াক এই ঘটনার বিবরণ দু’বার উল্লেখ্য করেন তার প্রথম উপন্যাস The Town And The City এবং  And the Hippos were Boiled in their Tanks এ।

বিটদের মাঝে কবি গ্যারি স্যান্ডার ছিলেন একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। গ্যারি ব্যাপকভাবে সমাদৃত ছিলেন বিট জেনারেশনের গ্রুপ মেম্বার হিসাবে। তিনি ছিলেন কবি এবং সেই সব কবিদের মধ্য অন্যতম যারা বিখ্যাত Six Gallery তে কবিতা পাঠ করতেন। নীল ক্যাসাডির বিট গ্রুপের সাথে পরিচয় ঘটে ১৯৪৭ সালে এবং সদস্য হিসাবে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করেন। গিন্সবার্গ, ক্যাসাডি দ্বারা আচ্ছন্ন হয়ে পড়েন এবং পরবর্তীতে তাদের মধ্য রোম্যান্টিক সম্পর্ক গড়ে উঠে। গিন্সবার্গ হয়ে যান তার ব্যাক্তিগত লেখ্য শিক্ষক। কেরুয়াকের সাথে ক্যাসাডির রোড ট্রিপটি হয়ে উঠে কেরুয়াকের বিখ্যাত উপন্যাস On The Road এর মুল উপজীব্য।

রোমান্টিকতার ক্ষেত্রে গিন্সবার্গের সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা ছিলেন উইলিয়াম ব্লেক। গিন্সবার্গ হয়তো সারাজীবন ব্লেককে পড়তে চেয়েছিলেন। যখন প্রথমবার মাইকেল ম্যাকক্লুয়ার মিলিত হন গিন্সবার্গের সাথে তারা কথা বলেছিলেন ব্লেককে নিয়েই। ম্যাকক্লুয়ার তাকে বিপ্লবী বলতেন আর গিন্সবার্গ তাকে দৈব বাণী প্রচারক হিসাবে দেখতেন।

On the Road কে বলা হয় বিট জেনারেশনের সবচেয়ে বড় প্রামাণ্য উপন্যাস। ১৯৫১ সালের এপ্রিলে মাত্র তিন সপ্তাহে এক লাখ পঁচিশ হাজার শব্দের উপন্যাসটি শেষ করেন ২৯ বছর বয়সী কেরুয়াক, ১২০ ফুট লম্বা একটি ট্রেসিং পেপারের রোল কে সাইজ করে কেটে তার উপর টাইপ করতে শুরু করেন কেরুয়াক। পরে পাতাগুলি আবার জোড়া দিয়ে দেন। ভাবগ্রস্থের মত টাইপ করে গেছেন মার্জিন, অণুচ্ছেদ অধ্যায় কিছুই রাখেন নি। তার বন্ধু ও যাত্রাসঙ্গী নীল ক্যাসাডির একটি চিঠি থেকেই নাকি কেরুয়াকের বিশ্ববিখ্যাত এ উপন্যাসের সূত্রপাত। কেরুয়াকের On The Road  উপন্যাসটি প্রকাশিত হয় ১৯৫৭ সালে।

নরম্যান পডহোরেজ  ছিলেন কেরুয়াক  এবং গিন্সবার্গের এর সহপাঠী। তিনি ছিলেন বিটদের সবচেয়ে বড় সমালোচক।  ১৯৫৮ সালে লেখা পডহোরেজের  Partisan Review Article এ  The know nothing Bohemians এ ছিল তীব্র সমালোচনা কেরুয়াকের “On The Road” ও The Subterraneasns এবং গিন্সবার্গের Howl এর। তার মূল সমালোচনা এটা ছিল যে বিটরা আলিঙ্গন করে বুদ্ধিবৃত্তি বিরোধী একটি স্বতঃস্ফুর্ত উপাসনায়, যা সহজেই রূপান্তর হতে পারে নির্বুদ্ধিতা ও বিশৃঙ্খলতার দিকে। তিনি আরও জোর দিয়ে বলেন, বিটদের সাথে অপরাধীদের সম্পর্ক ছিল।

beat-generation

গিন্সবার্গ ১৯৫৪ সালে The Village Voice  সাথে একটি  সাক্ষাৎকারে মত প্রকাশ করেন, যে বিটদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ, তারা ধ্বংস করছে জীবন ও সাহিত্যের মধ্যে পার্থক্য। বিটদের বিরুদ্ধে বুদ্ধিবৃত্তি বিরোধী অভিযোগ একটি অসার গর্ভ শূন্য কাজ। আমরা একই শিক্ষা ব্যবস্থার অংশ ছিলাম একই স্কুলে গিয়েছিলাম এবং তুমি নিশ্চয় জানো ওখানে ছিল বুদ্ধিজীবীরা এবং তারা ছিল বুদ্ধিজীবী। Podhoretz ছিল বিশ শতকের সাহিত্য থেকে দূরে। তার লেখা ছিল ১৮ শতকের মানসিকতা সম্পন্ন।

আজকের লেখাটা লম্বা না করে বরং নিজেদের সম্পর্কে বলা বিটদের কিছু চমৎকার মন্তব্য তুলে ধরা যাক।

তথাকথিত বিট প্রজন্ম হল বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠী থেকে আসা একগুচ্ছ মানুষের দঙ্গল, যারা এটা ধরে নিয়েছিল যে সমাজ তাদের থেকে সবকিছু চুষে নিচ্ছে।  -আমিরী বারাকা।

কেউ জানে না আমরা অণুঘটক ছিলাম নাকি আবিষ্কারক, নাকি শুধুই নিজেদের স্রোতে উপর বসে থাকা ফেনা। আমি মনে করি আমরা সেই তিনটা।  -গিন্সবার্গ।

জন মিলন হোমস এবং আমি বসেছিলাম এবং আলোচনা করছিলাম যে “ লস্ট জেনারেশনের মানে কী হবে এবং তার উত্তরকালীন অস্তিত্ব এবং আমি বলে উঠলাম তুমি জানো জন, এটাই সত্যিকারের বিট প্রজন্ম এবং সে লাফ দিল এবং বলল এটাই সঠিক।  -জ্যাক কেরুয়াক।

শেষ হয়নি এখনো, শোনেন যারা ভাবছেন যে বিট প্রজন্ম মানে অপরাধ, অপকর্ম, নৈতিকতা বিরোধী, শোনেন যারা আক্রমণ করেছেন এসব বিষয়ের প্রেক্ষিতে। তারা জানেননা ইতিহাস এবং আত্মার ব্যাকুলতা, আকাঙ্ক্ষা সম্পর্কে.. শোনেন, আসল ব্যাপার হল যারা বাজে সিনেমা তৈরি করছেন বিটদের নিয়ে, যেখানে নিষ্পাপ পত্নিদের ধর্ষণের দেখানো হচ্ছে “বিটনিক” দের দ্বারা.. শোনেন যারা থুতু ফেলছেন বিটদের উপর, একদিন বাতাস তাদের দিকে ফিরে আসবে।  -জ্যাক কেরুয়াক।

————————— 

1557142_770132646366252_2182627405475837235_oবনী ইসরাইলঃ কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ লিখছেন। চিত্রকলাতেও সমান আগ্রহ। 

One thought on “বিট জেনারেশন নিয়ে কিছু কথা।।বনী ইসরাইল

লেখা সম্পর্কে মতামত জানাতে ফেসবুক অথবা ইমেল ব্যবহার করুন।