অনুবাদ / গল্প / ভৌতিক গল্প

নরকের বেড়াল | স্টিফেন কিং | ভাষান্তর- এনামুল রেজা

হুইলচেয়ারে বসা বুড়োটাকে অসুস্থ আর আতংকিত মনে হচ্ছিল হালস্টনের, যেন মরবার জন্য তৈরি হয়ে আছে। এমনটা সে আগেও দেখেছে। হালস্টনের কারবারই মৃত্যু নিয়ে; এ পর্যন্ত তার খুনের তালিকায় যোগ হয়েছে আঠারোজন পুরুষ আর ছয়জন নারী। মৃত্যুমুখী দৃষ্টি কেমন হয়, সে জানতো।

প্রাসাদের মত বাড়িটা খুব চুপচাপ আর শীতল। শব্দ বলতে কেবল ঐ বড় পাথুরে ফায়ারপ্লেসের মেঝেতে আগুনের মৃদু চড়চড় আর বাইরে থেকে আসা নভেম্বুরে বাতাসের চাপা কান্না।  

‘একটা খুন করতে হবে তোমাকে’, উচ্চকিত কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বুড়োটা বললো, ‘যদ্দূর জানি এটাই তোমার কাজ।’

তথ্যটা কে দিয়েছে আপনাকে?

সাউল লজিয়া নাম লোকটার। সে বলেছে ওকে চেন তুমি।

হালস্টন মাথা নাড়লো। যদি লজিয়া এই ব্যাপারটার দালাল হয়, সব ঠিকঠাক থাকবার কথা।

কাকে মারতে চাইছেন আপনি?

হুইলচেয়ারের হাতলে বসানো কনসোলে একটা ছোট্ট বোতামে চাপ দিল ড্রোগান, শব্দ করে সামনের দিকে এগোতে শুরু করলো জিনিসটা। খুব কাছ থেকেই ভীতি, বার্ধক্য আর পেশাবের মিশ্র এক হলদেটে দুর্গন্ধ ভেসে এলো হালস্টনের নাকে। অসহ্য লাগছিল, তবু নির্বিকার শান্ত চেহারায় এর কোন ছাপ পড়তে দিলনা সে।

‘ভিকটিম ঐ তোমার পিছেই দাঁড়িয়ে আছে দেখো।’   

হালস্টন ঝড়ের গতীতে নড়েচড়ে উঠলো। রিফ্লেক্স এক অর্থে তার বাঁচা-মরার বিষয়, এর উপরেই নির্ভর করে সবকিছু। সোফা থেকে এক লাফে নেমে মেঝেতে হাঁটুগেড়ে বসলো সে, বিশেষ মাপে বানানো স্পোর্টস কোটের ভিতরে ঢুকে গেল এক হাত, স্প্রিং লোডেড শোল্ডার হোলস্টার থেকে দ্রুত তালুবন্দী হল ছোট্ট নলের .৪৫ হাইব্রিড রিভলবারটা। এত আয়োজন করে যার দিকে অস্ত্রটা তাক করা হল.. একটা বেড়াল।

ঘুমন্ত শিশু আর বৃদ্ধদের উপর চড়ে বসতে পছন্দ করে বিলাই, ওদের নিঃশ্বাস খেয়ে নেয়

মুহূর্তের জন্য হালস্টন আর বেড়ালটা তাকিয়ে রইল একে অন্যের দিকে। তারমত কল্পনাবিবর্জিত ও বাস্তববাদী লোকের পক্ষে বড় অদ্ভুত মুহূর্ত। বেড়ালটার দিকে হাঁটুগেড়ে অস্ত্র তাক করে একইসঙ্গে মনে হচ্ছিল এটাকে আগে কোথায় যেন দেখেছে সে, যদিও অমন উদ্ভট মার্কা কোন বেড়াল আগে দেখে থাকলে ভুলে যাওয়ার তো কথা নয়। 

মুখটা সমান দু’রঙে ভাগ করা: অর্ধেকটা কালো, অর্ধেকটা সাদা। সমান্তরাল দ্বিভাজন রেখাটা খুলি থেকে শুরু হয়ে নেমে এসেছে নাক হয়ে মুখ অব্দি। অন্ধকারে চোখদুটোকে মনে হচ্ছিল বিশাল। আগুনের আলোতে প্রায় গোলাকার তারাদুটি জ্বলজ্বল করছিল কালো কয়লার মত, যেন ঘৃণা জানাচ্ছে।

ভাবনাটা প্রতিধ্বনি হয়ে হালস্টনের কাছে ফিরে এলো: আমরা পরিচিত, তুই আর আমি। এরপর অকস্মাৎ তা মিলিয়ে গেলে পিস্তলটা যায়গামত রেখে উঠে দাঁড়ালো সে, ‘বুড়ামিয়া, আমার উচিত আপনার লাশ ফেলে দেয়া। ফাজলামো নিতে পারিনা একদম।’

নিজের অসাড় দুই পা ঢেকে রাখা কম্বলের নিচ থেকে মোটা এক খাম বের করতে করতে ড্রোগান বললো, ‘আমিও ফাজলামো করিনা ইয়াং ম্যান। বসো এখানে।’  

হালস্টন বসলো। তখন সোফার পেছন বেয়ে উঠে এলো বেড়ালটা, হালকা লাফ দিয়ে পড়লো কোলের উপর। বড় বড় চোখ মেলে একবার তাকালো হালস্টনের দিকে, কালো চোখের মণিদুটোকে ঘিরে রেখেছে সবুজ-সোনালী রঙের বলয়, জুত করে বসে ‘গরর গরর’ শুরু করলো। 

চোখে প্রশ্ন নিয়ে হালস্টন চাইলো ড্রোগানের দিকে।

‘বিরাট মিশুক ওটা। প্রথম প্রথম তাই মনে হবে। ওই চমৎকার মিশুক বিলাই এ বাসার তিনজন মানুষকে মেরে ফেলেছে। মানে শুধু আমিই বাকি আছি। হতে পারি বৃদ্ধ, হতে পারি অসুস্থ .. কিন্তু আমি আমার সময় এলেই মরতে চাই, তার আগে না।’

হালস্টন বললো, ‘এখনও বিশ্বাস হচ্ছেনা ব্যাপারটা। আপনি আমাকে ঠিক করেছেন একটা বিলাই মারার জন্য?’

‘দয়া করে খামের ভিতরটা দেখো।’

হালস্টন তাই করলো। খামটা ভরে ছিল একগাদা মলিন একশ আর পঞ্চাশ ডলারের নোটে। সে জিজ্ঞেস করলো, ‘কত আছে এখানে?’

‘ছয় হাজার। আরও ছয় হাজার পাবে যখন কাজটা শেষ করে তার প্রমাণ দেখাতে পারবে। লজিয়া বলেছিল বারো হাজার ডলার তোমার ফি?’

হালস্টন মাথা নাড়লো, নিজের অজান্তেই সে হাত বুলাচ্ছিল কোলের উপরে ঘুমন্ত বেড়ালটার গায়ে। শব্দ করছিল ওটা ঘুমের মধ্যেও। বেড়াল সে পছন্দ করত। বস্তুত, প্রাণীদের মাঝে বেড়ালই ছিল তার একমাত্র পছন্দের। এরা ভয়ানক স্বনির্ভর। ঈশ্বর বলে যদি কেউ থাকেন, তিনি এদের বানিয়েছিলেন এক নিখুঁত খুনে যন্ত্র হিসেবে। প্রাণী জগতে বেড়াল হল সত্যিকার শিকারি, এবং হালস্টন ওদের সেই প্রাপ্য সম্মানটা সব সময় দিত।

‘কোন কিছু খুলে বলবার প্রয়োজন মনে করিনা আমি, তবু বলছি। লোকে বলে, সতর্করাই সৌভাগ্যবান, বিষয়টাকে মোটেও হালকা ভাবে নেবেনা। মনে হচ্ছে, নিজে যে ঠিকঠাক আছি, উন্মাদ নই, এটাও তোমার পরিষ্কার বোঝা দরকার।’

হালস্টন ফের মাথা নাড়লো। উদ্ভট কাজটা সে করবে, আর কোন কথার আসলে দরকারও নেই। কিন্তু যদি ড্রোগান চায় কথা বলতে, শুনতে আপত্তি কোথায়? 

‘পয়লা বিষয় হল, তুমি কি চেন আমাকে? মানে আমার এত টাকা-পয়সা কোত্থেকে আসে, এসব?’ 

‘ড্রোগান ফার্মাসিউটিক্যালস?’

‘ঠিক ধরেছ। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ওষুধ কোম্পানীগুলোর একটা। আমাদের কোম্পানী যে আর্থিকভাবে এত সফল, তার মূল কারণ এগুলো, রোবের পকেট থেকে কয়েকটা পিল বের করে সে হালস্টনের হাতে দিল। ট্রি ডরমাল-ফেনোবারবিন, কম্পাউন্ড জি। টার্মিনালি অসুস্থ পেশেন্টদের জন্য আরকের কাজ করে পিলগুলো। মারাত্মকভাবে হ্যাবিট-ফরমিং, বুঝলে? পেইন-কিলার, ট্রাংকুলাইজার এবং মাইল্ড হ্যালুসিনোজেনের একটা ককটেল বলতে পারো। মুমূর্ষু যে কোন পেশেন্টকে ওষুধটা তাদের যন্ত্রণাদায়ক অবস্থার সঙ্গে মানিয়ে নিতে সাহায্য করে।’

‘আপনি খান এটা?’

প্রশ্নটা এড়িয়ে গেল ড্রোগান। বলে চললো, ‘দুনিয়াজুড়ে প্রেস্ক্রাইবড হচ্ছে এই পিল। সিনথেটিকটা পঞ্চাশের দশক থেকে আমাদের নিউ জার্সির গবেষণাগারে ডেভেলপ করা হচ্ছিল। পরীক্ষাগুলো আমরা করতাম শুধু বিলাইয়ের উপরে কারণ এই প্রাণীগুলোর নার্ভ সিস্টেম অদ্বিতীয়।’

‘কতগুলোকে মেরেছেন এই পরীক্ষা করতে গিয়ে?’

রুঢ় কন্ঠে ড্রোগান জবাব দিল, ‘ব্যাপারটাকে এইভাবে দেখলে অবিচার করা হয়। চার বছরের গবেষণায় প্রায় পনেরো হাজারের মত বিলাই .. লেগেছে আমাদের।’

শিষ দিয়ে উঠল হালস্টন, ‘মানে এক বছরে গড়ে প্রায় চার হাজার বিলাই। এবং এখন আপনার মনে হচ্ছে, ওগুলো থেকে একটা ফিরে এসেছে প্রতিশোধ নিতে?’

‘এ নিয়ে কোন অপরাধবোধ নেই আমার, একটুও না।’ ড্রোগানের কন্ঠে সেই আগের কাঁপা কাঁপা শিশুতোষ ভাবটা ফিরে এলো আবার। ‘পনেরো হাজার বিলাইকে মরতে হয়েছে যাতে কোটি কোটি মানুষ ..’

সে বললো, ‘থাক বাদ দিন না।’ কৈফিয়ত চিরকাল ক্লান্ত করত তাকে।

‘বিলাইটাকে এ বাড়িতে প্রথম দেখেছিলাম মাস সাতেক আগে। ওদের কখনই পছন্দ করতাম না আমি। নোংরা, অসুখ বিসুখের ডিপো .. সব সময় যেখানে সেখানে ঘুরে বেড়াচ্ছে .. কখনও মাঠে তো কখনও রান্নাঘরে .. ঈশ্বর মালুম পশমের ভিতর কত রকমের জার্ম নিয়ে ওরা ঘুরে বেড়ায় .. যখনই ভিতরে ঢুকবে বাইরে থেকে কিছু না কিছু এনে নোংরা করবে ঘর .. বিলাইটাকে পুষতে শুরু করেছিল আমার বোন। ও তার কর্মের যোগ্য প্রতিদানও পেয়েছে। কথাগুলো বলতে বলতে হালস্টনের কোলের উপর ঘুমন্ত বেড়ালটার দিকে চাইলো ড্রোগান, দৃষ্টিতে ভয়ানক ঘৃণা।’

‘আপনি বলছিলেন বেড়ালটা তিনজনকে খুন করেছে?’

ড্রোগান বলতে শুরু করলো। হালস্টনের রুক্ষ খুনে আঙ্গুলগুলোর আদরে বেশ ঝিমোচ্ছে বেড়ালটা, কণ্ঠ থেকে মৃদু গরগর আওয়াজ আসছে অবিরাম। মাঝেমধ্যে ফায়ারপ্লেসে পটপট করে ফাটছে পাইনের ডাল। কানেকটিকাটের গ্রামাঞ্চল থেকেও বহু দূরের এক এলাকায় দাঁড়িয়ে থাকা এ বিশাল পাথুরে বাড়িটার চারপাশে হাওয়া খেলছে শোঁশোঁ শব্দে, যে হাওয়া তার ঠোঁটে করে বয়ে আনে শীতকাল। বাড়িটার সবখানে অবাধে ভেসে বেড়াচ্ছে ড্রোগানের কণ্ঠস্বর।

সাতমাস আগেও এ বাড়িতে চারজন মানুষের বসবাস ছিল। ড্রোগান, তারচেয়ে বছর দুয়েকের বড় বোন আমান্ডা, বায়াত্তরের মত হয়েছিল বয়স, আমান্ডার দীর্ঘদিনের বান্ধবী ক্যারোলিন ব্রডমুর, বেচারি দারুণ শ্বাসকষ্টে ভুগত। আর ছিল বিশ বছরের পুরনো কর্মচারী ডিক গেজ, তার বয়সও ষাটের উপরে, বিশাল আকারের লিংকন মার্ক ফাইভ গাড়িটা চালানো, রান্না করা, বিকেলের আড্ডায় সবার গ্লাসে শেরি ঢেলে দেওয়া, এইসব করতো। একটা ঠিকা কাজের মেয়ে আসতো রোজ, কাজ সেরে চলে যেত। চারজন মানুষ একই ভাবে প্রায় বছর দুয়েকের মত কাটিয়ে দিয়েছিল এখানে, একদল বুড়ো-বুড়ির ক্লান্তিকর জীবন যেমন হতে পারে আরকি। তাদের একমাত্র বিনোদন ছিল ড্রয়িংরুমে বসে হলিউড স্কয়ার নামের টিভি শো দেখা।

তারপরেই এসেছিল বেড়ালটা।

‘ওকে সবার আগে দেখেছিল গেজ, কোত্থেকে এসে ঘরের ভিতর ঘুরে বেড়াচ্ছিল, শব্দ করছিল নিজের মত। লাঠি দেখিয়ে, ছোট ছোট পাথর ছুঁড়ে বিলাইটাকে বেশ কয়েকবার তাড়িয়ে দেবার চেষ্টা করেছিল সে। কিন্তু গেলে তো? তাড়িয়ে দিলেও ফের চলে আসতো। খাবারের ঘ্রাণ পেয়েছিল মনে হয়, যেতে চাইতনা। একটা ছোট্ট হাড়ের পুঁটলি ছাড়া আর কী বলা যায় ওটাকে? গ্রীষ্মের শেষাশেষি লোকজন বিলাইগুলোকে বের করে রাস্তার পাশে মরার জন্য ফেলে রেখে আসে, তুমি তো জানো। একটা ভয়ানক, অমানবিক ব্যাপার যাকে বলে।’

হালস্টন জিজ্ঞেস করলো, ‘গবেষণাগারে যন্ত্রণা দিয়ে মারার চাইতে তো ভাল নাকি?’

প্রশ্নটা এড়িয়ে ড্রোগান নিজের মত বলে চললো। বেড়াল ঘেন্না করতো সে। চিরকাল। তাড়িয়ে দিলেও যখন বারবার ফিরে আসছিল, সে গেজকে বলেছিল, ‘বিষ দিয়ে মেরে ফেল ওটাকে।’ বড় ডিশে লোভনীয় ক্যাটফুড ফ্রিস্কির উপর ট্রাই-ডরমাল-জি ছিটিয়ে দিয়েও কোন লাভ হতনা। ও স্রেফ এড়িয়ে যেত। তারপর একদিন আমান্ডার চোখে পড়ে গেল ব্যাপারটা, সে প্রায় জোর করেই আশ্রয় দিতে চাইল বেড়ালটাকে। ড্রোগান জোর বাধ সেধেছিল। কিন্তু কে শোনে কার কথা? আমান্ডা যা চাইত, আদায় করে ছাড়তো।

‘আমান্ডার কোলে চড়েই এ ঘরে আশ্রয় পেয়েছিল বিলাইটা। এখন যেমন গরগর করছে, তখনও করছিল। কিন্তু আমার কাছে ঘেঁষতোনা মোটে.. এখন পর্যন্ত ঘেঁষেনি। একটা বাটিতে দুধ ঢেলে ওকে খেতে দিত আমান্ডা, বলতো আহা, দেখ দেখ, ক্ষুধায় কী কষ্টই না পাচ্ছে বেচারা। সে আর ক্যারোলিন, দুই বান্ধবী আহ্লাদে কুক দিয়ে উঠতো একদম। জঘণ্য। আমাকে রাগাবার জন্য করতো কাজটা। বিলাই নিয়ে আমার মনভাব কেমন ছিল ওরা জানতো।’

‘আমাকে খুঁচিয়ে মজা পাওয়া’, হালস্টনের দিকে হিংস্র দৃষ্টিতে চাইলো ড্রোগান, ‘অবশ্য এর মূল্যও ওদের দিতে হয়েছিল।’  

মে মাসের মাঝামাঝি এক সকালে ব্রেকফাস্ট তৈরি করতে উঠে গেজ দেখেছিল মূল সিঁড়ির নিচে পড়ে আছে আমান্ডা ড্রোগান, খাবার পাত্রটার ভাঙা টুকরো আর চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ফ্রিস্কি। চোখদুটো কোটোর ঠেলে সামান্য বেরিয়ে এসে চেয়ে আছে উপরের দিকে। নাক-মুখ থেকে রক্ত ঝরেছে অনেক। মেরুদন্ডের হাড় ভেঙে গিয়েছিল তার, পা দুটিও, এবং ঘাড়টা ভেঙে একদম যেন কাঁচের মত গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে গিয়েছিল।

ড্রোগান বলে চলে। আমান্ডার রুমেই ঘুমাত বিলাইটা। একটা বাচ্চার মত করে দেখে রাখত.. ‘ওলে বাচ্চাটা, খুব ক্ষুদা লেগেছে না? উলে উলে, এখন বুঝি হিসি করা লাগবে সোনা?’ আমার বোনের মত একটা বুড়ি ধামসি অমন ঢং করছে, ভাবতে পারো? সহ্য হতোনা চোখে। মনে হয়, ভোরের দিকে মিউ মিউ করেই আমান্ডার ঘুম ভাঙিয়েছিল। সে খেতে দিত ওকে, বলতো, ‘ফ্রিস্কির মধ্যে একটু দুধ ছিটিয়ে না দিলে আমার স্যামটা খেতে পারেনা।’ স্যাম এই করে, স্যাম সেই করে, স্যাম বালটা করে। সুতরাং দুধ নেবার জন্যই উপর থেকে নিচে নামছিল। হয়ত বিলাইটা ওর পায়ে পায়ে গা ঘষছিল অনবরত। বয়স হয়েছিল আমান্ডার, খুব শক্ত পায়ে হাঁটতে তো পারতোনা। আধ-ঘুমন্ত অবস্থায় ছিল। বিলাইটাকে এড়িয়ে সিঁড়ি ভাঙবার সময় কোন একভাবে তার পা হড়কে গিয়ে থাকবে ..  

হালস্টন ভাবলো তাও ঠিক, হয়ত এভাবেই ঘটেছিল দুর্ঘটনাটা। মনের চোখে সে দেখতে পেলো, বুড়ি আমান্ডা সিঁড়ির উপর থেকে গড়িয়ে গড়িয়ে নিচে পড়ছে, প্রতি ধাপে শরীরের কোন না কোন অংশে প্রচন্ড আঘাত পাচ্ছে, মাথায়, পায়ে, হাতে, কোমরে, গর্দানে। ঘটনার আকস্মিকতায় বুড়ি ভুলে গেছে চিৎকার করতেও। ফ্রিস্কির দানাগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ছে, ঐ তার মাথা বাড়ি খেলো মেঝেতে আর চিনেমাটির পাত্রটা ভেঙে হল খানখান। অবশেষে নিঃসাড়ে চিতিয়ে পড়লো সিঁড়ির নিচে, হাড়গোড় সব চুরমার, চোখগুলো বেরিয়ে এসেছে কোটোর ঠেলে, নাক আর কান দিয়ে রক্তের ধারা ছুটেছে। ঐ তো গরগর করতে থাকা বিলাইটা নির্বিকার পায়ে নেমে এল নিচে, বুড়ির চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ফ্রিস্কি চিবোতে শুরু করেছে ..

সে ড্রোগানকে জিজ্ঞেস করলো, ‘ডাক্তার কী বলেছিলেন?’

‘দুর্ঘটনায় মৃত্যু, নিশ্চিত ভাবেই। কিন্তু আমি জানতাম।’

‘আমান্ডার মৃত্যুর পরেও কেন বিলাইটাকে সরিয়ে দিলেন না আপনি?’

কারণ ক্যারোলিন ব্রডমুর হুমকি দিয়েছিল যদি ওটাকে তাড়িয়ে দেওয়া হয় সেও এ বাড়ি থেকে চলে যাবে। উন্মাদের মত হয়ে গিয়েছিল তো, ওর এক রকমের আসক্তি জন্মে গিয়েছিল বিলাইটার উপরে। অসুস্থ মহিলা, কী আর বলবো। আদি-ভৌতিক বিষয়-আশয়ে গোঁড়ার মত বিশ্বাস করতো। হার্টফোর্ডের এক তান্ত্রিক ওকে বলেছিল (হয়ত মাত্র বিশ ডলারের বিনিময়ে) যে স্যামের শরীরে কোন একভাবে আমান্ডার আত্মা ঢুকে গিয়েছে। তার মানে স্যাম আর আমান্ডায় কোন পার্থক্য নেই। ড্রোগানকে এমনটাই জানিয়েছিল ক্যারোলিন, যদি স্যাম এ বাড়িতে যায়গা না পায় সেও থাকবেনা। 

মানুষের জীবন সম্পর্কে অনুমানের একটা বিচিত্র রকমের দক্ষতা তৈরি হয়েছিল হালস্টনের মধ্যে। তার মনে হল, যৌবনে হয়ত ক্যারোলিন আর ড্রোগান ভালবাসতো একে অন্যকে, আজ এতদিন পর সামান্য এক বেড়ালের কারণে বুড়িটা তাকে ছেড়ে চলে যাক, ড্রোগান তা চায়নি। 

‘আত্মহত্যা করতে চাওয়া ছাড়া আর কী বলবো এটাকে? মনে মনে ক্যারোলিন তখনও নিজেকে খুব পয়সাঅলা এক রমণী মনে করতো, যেন চাইলেই বিলাইটাকে সঙ্গে নিয়ে নিউ ইয়র্ক, লন্ডন কিংবা মন্টে কারলোর কোন এক বিলাসবহুল ফ্ল্যাটে গিয়ে উঠতে পারবে। আদতে সে ছিলও এক নামজাদা পরিবারের শেষ চিহ্ন, ষাটের দশকের গাদাখানেক বাজে বিনিয়োগে লস করে ওসব থেকে যা যৎসামান্য পয়সাকড়ি আসতো তা দিয়েই চলতো। থাকতো এ বাড়ির দো’তলায় বিশেষভাবে নিয়ন্ত্রিত একটা এয়ার কন্ডিশনড রুমে। ও সত্তরে পড়েছিল হালস্টন। প্রচুর সিগারেট খেত আগে, অ্যাাজমার সমস্যাটা বিশ্রিরকম বেড়ে যাবার পর শেষ দু’বছরে ছুঁয়েও দেখেনি জিনিসটা। যে কোন মূল্যেই আমি চেয়েছিলাম ও এ বাড়িতে থাকুক, এবং বিলাইটাকে যদি রাখতে হত তাও সই ..’  

হালস্টন মাথা নাড়লো, মতলব নিয়েই একবার তাকালো নিজের রিস্টওয়াচের দিকে।

‘জুনের শেষাশেষি এক রাতে ক্যারোলিন মারা গেল। ডাক্তার এসে সব দেখে-শুনে স্বাভাবিক মৃত্যু হিসেবেই ঘোষণা করলেন ব্যাপারটাকে। কিন্তু গেজ আমাকে জানায়, ঐ রাতে বিলাইটা ক্যারোলিনের রুমেই ছিল।’

হালস্টন একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো, ‘আমাদের সবাইকে একদিন না একদিন মরতে হবে বুড়ামিয়া।’

‘তা বটে। ডাক্তারও এমনটাই বলেছিলেন। কিন্তু আমি জানতাম। ঘুমন্ত শিশু আর বৃদ্ধদের উপর চড়ে বসতে পছন্দ করে বিলাই, ওদের নিঃশ্বাস খেয়ে নেয়।’

‘এটা গ্রাম্য মহিলাদের কেচ্ছা।’

‘কেচ্ছা হলেও বাস্তব থেকেই ওসব তৈরি হয়, যেমনটা অন্য সব গালগল্পের ক্ষেত্রেও সত্যি। বিলাইয়েরা নরম জিনিসের উপর থাবা গেড়ে বসতে ভালবাসে, বুঝলে? একটা বালিশ কিংবা পশমি কম্বল। একটা বাচ্চা বা বুড়োর জন্য তৈরি নরম বিছানা। এমন কারও বুকের উপর চড়ে বসা, যার শ্বাস গ্রহণ প্রক্রিয়াটা দুর্বল ..’

কথার খেই হারিয়ে ফেললো ড্রোগান, আর হালস্টন ভাবলো পুরো ঘটনাটা। ক্যারোলিন ব্রডমুর তার বেডরুমে ঘুমিয়ে আছেন। প্রায় অচল ফুসফুস কোন রকমে চালিয়ে নিচ্ছে শ্বাস-প্রশ্বাসের কাজ যার নিচু শব্দ ঢেকে যাচ্ছে হিউমিডফায়ার আর এয়ার কন্ডিশনারের গুঞ্জনে। কালো আর সাদা মুখের বেড়ালটা এগিয়ে এলো শব্দহীন পায়ে, এরপর এক লাফে উঠে পড়লো খাটে, উজ্জ্বল কালো ও সবুজাভ দু’চোখ মেলে চেয়ে রইলো বুড়িটার বলিরেখায় ভরা মুখের দিকে। এরপর তার শীর্ণ বুকের ওপর দেহের ভার ছেড়ে দিয়ে গুটিয়ে-শুটিয়ে বসে পড়লো, মৃদু গরগর শব্দ বেরুতে শুরু করলো ওটার কন্ঠ থেকে .. বেড়ালটির গরগরানি যত বাড়ছে, তার শরীরের নিচে আস্তে আস্তে রুদ্ধ হতে শুরু করেছে ক্যারোলিনের নিঃশ্বাস।

কল্পনাবিবর্জিত এক মানুষ হালস্টন, তবুও দৃশ্যটা ভেবে সে একটু কেঁপে উঠল। বেড়ালটার নরম গায়ে আঙুল বুলাতে বুলাতেই ড্রোগানকে বলল, ‘এখনও কেন সরিয়ে দেননি এটাকে? কোন এক পশু ডাক্তারকে বিশ ডলার দিলেই তো কাজটা সারা হয়ে যেত।’

ড্রোগান বললো, ‘ফিউনারেল ছিল জুলাইয়ের পয়লা তারিখে। পারিবারিক গোরস্থানে আমান্ডার পাশেই মাটি দিলাম ক্যারোলিনকে। যেমনটা সে চাইত সব সময়। জুলাইয়ের তিন তারিখে গেজকে এই ঘরে ডেকে একটা বাঁশের ঝুড়ি ধরিয়ে দিলাম .. একটা পিকনিক বাস্কেটের মত জিনিসটা। তুমি কি বুঝতে পারছ কী বলতে চাইছি?’

হালস্টন মাথা নাড়ল।   

আমি গেজকে বলেছিলাম, ‘ঝুড়ির ভিতর বন্দী আছে বিলাইটা, মিলফোর্ডে এক পশু ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবি। ওটাকে যেন চিরঘুমে পাঠিয়ে দেয়া হয়।’

‘বাক্সটা নিয়ে সে রওনা হয়েছিল। হুকুম পালনে সব সময়েই ওরকম ছিল গেজ। কোন দ্বিতীয় বাক্য ব্যায় করতে হতনা। সেই যে গেল, এরপর আর কখনও জীবিত দেখিনি ওকে। দুর্ঘটনাটা ঘটে টার্নপাইকের ওদিকে। বিশাল লিংকন ফাইভটা এক ব্রিজের মোড়ে ধাক্কা খায় প্রায় ষাট মাইল বেগে। মুহূর্তেই ভবলীলা সাঙ্গ হয় গেজের। যখন লোকজন ঘটনাস্থলে পৌছোয়, ওর মুখে ভরে ছিল আঁচড়ের দাগে।’

হালস্টন চুপচাপ বসে রইলো যেন দুর্ঘটনার দৃশ্যগুলো তার মগজে তৈরি হচ্ছে ফের। ফায়ারপ্লেসের আগুন থেকে আসা পটপট বাজনা আর বেড়ালটির গরগরানি ছাড়া অন্য কোন শব্দ নেই এ ঘরে। আগুনের সামনে সে আর তার কোলে একটা বেড়াল, চিত্রটা এডগার গেস্টের কবিতার জন্য একটা চমৎকার ইলাস্ট্রেশন হতে পারে, ঐ যে কবিতাটা: বেড়ালটি আমার কোলে, ফায়ারপ্লেসের মেঝে জুড়ে আগুনে উদ্যান / .. একজন সুখী মানুষ, তুমি করো অনুসন্ধান

ডিক গেজ লিংকনটাকে টার্নপাইকের নিচ দিয়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে নিচ্ছিল। ঘন্টায় সর্বোচ্চ পাঁচ মাইল বেগে। পেছনের সিটে পড়ে ছিল বেতের ঝুড়িটা। সে হয়ত পাশ কেটে বেরিয়ে যাওয়া একটা বড় ক্যাবের দিকে চেয়ে ছিল, খেয়াল করেনি যে মুখের একদিকে সাদা অন্যদিকে কালো রঙা বেড়ালটা ঝুড়ির কোন এক ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে পড়েছে। লাফ দিয়ে চলে এসেছে ড্রাইভিং সিটের পাশে। গেজের খেয়াল করবার কথাও না কারণ তখন সে তাকিয়ে আছে উল্টো দিক থেকে আগুয়ান আরেকটা বড় ট্রেলার ট্রাকের দিকে, সে মুহূর্তেই বেড়ালটা তার মুখের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে অনবরত থাবা বসাতে শুরু করলো, নখ দিয়ে আহত করলো একটা চোখ, ফুটো করে দিল। লিংকনের বড় ইঞ্জিন থেকে আসছিল ষাট মেগাহার্জের গমগমে শব্দ আর বেড়ালটি অন্য থাবায় গেজের নাকে খুঁচিয়ে চললো – অবর্ণনীয় যন্ত্রণার এই সময়টিতেই লিংকনটা ঘুরে গেল ডানপাশে, যে দিক দিয়ে আসছিল দানবাকৃতি ট্রেলার ট্রাকটা, কানের পর্দা ফাটিয়ে দেবার মত জোরে ওটার হর্ণ বেজে উঠলেও কিছুই শুনতে পেলনা গেজ কারণ শুনবার মত অবস্থা তার ছিলনা, বেড়ালটা গর্জে যাচ্ছিল, বেড়ালটা একটা পশমি মাকড়সার মত আঁকড়ে ছিল গেজের মুখের উপর, কানগুলো পেছনে বাঁকানো, সবুজ চোখজোড়া জ্বলছে নারকীয় আলোয়, পিছনের পা দুটোর থাবা বসে যাচ্ছে বুড়ো লোকটির ঘাড়ের নরম মাংসে। গাড়িটা বন্য গতিতে ব্রিজের উল্টোপাশে এগিয়ে যাচ্ছিল, এরমাঝেই বেড়ালটা একটা চকচকে কালো টর্পেডোর মত বেরিয়ে এলো বাইরে, লিংকন ফাইভ সিমেন্টের দেয়াল সজোরে ধাক্কা খেয়ে উড়ে গেল মুহূর্তেই।

কন্ঠতালু শুকিয়ে এসেছিল হালস্টনের, শুকনো একটা ঢোক গিললো সে।

‘এরপর বিলাইটা ফিরে এসেছিল?’   

ড্রোগান মাথা নাড়লো, ‘এক সপ্তাহ পর। যেদিন ডিক গেজকে মাটি দেয়া হয়। ঠিক যেন সেই প্রাচীন সঙ্গীতের মত: বেড়ালেরা ফিরে আসে ..’

‘ষাট মাইল গতীর একটা কারক্র্যাশ থেকে ওটা বেঁচে ফিরেছে? বিশ্বাস করা কঠিন।’

‘লোকে বলে, ওরা প্রত্যেকে নয়টা করে জীবন পায়। যখন বিলাইটা ফিরে এলো, ঠিক তখন আমার মনে হতে থাকে, তবে কী, তবে কী হতে পারে ওটা একটা .. একটা ..’

‘নরকের বিলাই?’

‘আরও ভাল কোন শব্দ দরকার। এক ধরণের শয়তান তাড়িত ..’

‘ওটা ফিরে এলো আপনাকে শাস্তি দিতে?’

‘জানিনা। কিন্তু ভয় লাগে। আমি টের পাই ব্যাপারটা, এমনকি যে মহিলা এসে আমাকে খাইয়ে দিয়ে যায়, ও বলে, ঐ মুখটা হল ঈশ্বরের অভিশাপ। অবশ্য, মেয়েটা স্থানীয়। ঠোঁটে ব্যার্থ হাসি ফোটাবার চেষ্টা করলো ড্রোগান। মারতে চাই ওটাকে আমি। গত মাস চারেক ধরে এ বাড়িতে শুধু ও আর আমি। ছায়ার নিচে নিচে ঘুরে বেড়াচ্ছে, চেয়ে থাকছে আমার দিকে নিষ্পলক। মনে হয় যেন .. কিছুর জন্য অপেক্ষা করছে। রাতে নিজের রুমটা খুব ভালমত বন্ধ করে ঘুমাই, তবু মনে হয়, কোন এক ভোরে উঠে দেখব বুকের উপর শুয়ে আছে ওটা, গরগর গরগর করছে।’  

তখন বাইরে খেলা করে যাচ্ছিল নিঃসঙ্গ বাতাসের শব্দ যা পাথুরে চিমনির ভেতর ঢুকে পড়ে জন্ম দিচ্ছিল এক বিচিত্র হুটোপুটির। এসবের মাঝে ড্রোগানের কণ্ঠ বেজে চললো, ‘বহুকষ্টে সাউল লজিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারি আমি। সে তোমার কথা জানায়। ও বলেছিল, তুমি একাই কাজ করো?’

‘নিজের কাজ একা হাতে করতেই পছন্দ করি আমি।’

‘হ্যাঁ। লজিয়া বলেছে, কখনও ধরা খাওনি, এমনকি কেউ কোনদিন সন্দেহও করেনি। ঠিক একটা বিলাইয়ের মত নিঃশব্দে শিকার করতে পারো তুমি ..’  

হুলচেয়ারে বসা বৃদ্ধ লোকটির দিকে চাইলো হালস্টন, এবং হঠাৎ করেই তার দীর্ঘ আঙুলগুলো ধরলো বেড়ালটার ঘাড় বরাবর, নরম কন্ঠে বললো, ‘আপনি চাইলে এ মুহূর্তেই কাজটা করতে পারি। আঙুল দিয়ে স্রেফ ঘাড়টা মটকে দেব, ওটা এমনকি টেরও পাবেনা।’

প্রায় কাঁদোকাঁদো কণ্ঠে ড্রোগান বললো, ‘না না।’ লম্বা একটা শ্বাস নিল। তার ফ্যাকাশে গালে কিছুটা রঙ ফিরে এসেছে। ‘না, এখানে না। তুমি ওটাকে নিয়ে যাও এ বাড়ি থেকে।’   

বৃদ্ধকে নিষ্প্রাণ একটা হাসি ছুঁড়ে দিল হালস্টান। বেড়ালটার পিঠে আর কাঁধে আবার আঙুল বোলাতে শুরু করেছে।

‘বেশ, কাজটা নিলাম আমি। আপনি কি ডেডবডি দেখতে চান?’

‘নাহ। মেরে ফেলো ওটাকে। পুঁতে দিও কোথাও।’ প্রাচীন এক বাজের মত হুইলচেয়ার থেকে সামনে ঝুঁকে পড়ে ড্রোগান বললো, ‘শুধু লেজটা এনে দিও আমাকে যাতে ফায়ারপ্লেসের আগুন ছুঁড়ে মারতে পারি, দেখতে পারি কীভাবে ওটা পোড়ে।’

কাস্টম স্পয়লার ইঞ্জিন বসানো একটা ১৯৭৩ প্লাইমাউথ চালাতো হালস্টন। গাড়িটা নিজের মত করে মডিফাই করে নিয়েছিল সে। টায়ারগুলো ছিল বিশাল আকারের ববি উনসার ওয়াইড ওভাল, ঘন্টায় সর্বোচ্চ একশ ষাট কিলোমিটার বেগে ছুটতে পারতো।

সে ড্রোগানদের বাড়ি থেকে বেরুলো রাত সাড়ে ন’টার একটু পরে।

আকাশে নভেম্বরের ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘের মাঝখান দিয়ে উঁকি দিচ্ছিল উজ্জ্বল চাঁদ। সবকটা জানালা খোলা রেখেই এগোতে শুরু করলো সে যেন তার পোশাকে বসে যাওয়া বার্ধক্য আর ভীতির হলদেটে ধুলোরা বাতাসে উড়ে যায়। হুহু করে ঠান্ডা কনকনে হাওয়া আসছিল বাইরে থেকে, বড় ভাল লাগছিল তার।

প্লেসার্স গ্লেনের কাছাকাছি একটা টার্নপাইক পার হয়ে এলো হালস্টন, নিস্তব্ধ শহরের মাঝখান দিয়ে চলেছে একা একা। শহর থেকে বেরিয়েই সে প্লাইমাউথের গতি খানিকটা বাড়িয়ে দিল। টিউন করা স্পয়লার ইঞ্জিন গরগর শুরু করলো যেমনটা বিকেলের দিকে ঐ বেড়ালটা করছিল তার কোলে বসে। উপমাটার কথা ভেবে বাঁকা একটা হাসি ফুটে উঠলো ঠোঁটের কোণে। দু’পাশে তুষারশুভ্র পাকা ভুট্টোক্ষেতের মধ্যে দিয়ে ঘন্টায় প্রায় সত্তর মাইল বেগে ছুটছে গাড়ি।

বেড়ালটা ছিল ডাবল লেয়ারের একটা শপিং ব্যাগের মধ্যে, শক্ত দড়িতে বাঁধা। ব্যাগটা পড়েছিল পাশের সিটেই। হালস্টন যখন ওটাকে ভিতরে ঢুকাচ্ছিল বেঁধে, তখনও প্রায় ঘুমিয়েই ছিল, গরগর করছিল। মনে হয় বুঝতে পেরেছিল হালস্টন পছন্দ করেছে তাকে। যেন সে ওর মতই, একলা চলোরে টাইপ। 

আজব শিকার। হালস্টন ভেবে অবাক হল যে সত্যিই জিনিসটাকে একটা শিকার হিসেবে ধরে নিয়েছে। সবচেয়ে অদ্ভুত ব্যাপার, বেড়ালটার প্রতি এক ধরণের মমতা জাগছিল তার মনে। যদি এটা ঐ তিন বৃদ্ধের কবল থেকে ছাড়াই পেয়ে থাকে, দারুণ ব্যাপার .. বিশেষত গেজের কথা ধরা যাক, হয়ত মিলফোর্ডের কোন খাটো চুলের পশুচিকিৎসকের কাছে নিয়ে যেত ঝুড়িটা যে নির্বিকার চিত্তে সিমেন্টে তৈরি গ্যাস চেম্বারে ঢুকিয়ে দিত প্রাণীটাকে। এসব ভেবে মমতাবোধটা আরও বেড়ে গেল। যদিও চুক্তির খেলাপ সে করবেনা, করেনি কোনদিন। যতটা সম্ভব সম্মানের সঙ্গে মারতে হবে বেড়ালটাকে, দ্রুত এবং নির্ভুলভাবে। কোলে নিয়ে আদর করতে করতে ঘাড়টা মটকে দেয়া শুধু। তারপর পরিত্যক্ত কোন মাঠে পুঁতে দেবে সুন্দর করে। যাতে আর কোন বন্যপশু খুঁড়ে বের করতে না পারে। 

সে যখন এসমস্ত ভাবছিল, রাত্রির অন্ধকার ভেদ করে নীলচে একটা ভুতের মত এগিয়ে যাচ্ছিল প্লাইমাউথ ভি ফাইভ এবং তখনই সে বেড়ালটাকে দেখতে পেল। ড্যাশবোর্ডের উপরে দাঁড়িয়ে আছে লেজ খাড়া করে, সাদাকালো মুখটা তার দিকে ফেরানো, দেখে মনে হচ্ছে যেন বিদ্রুপ করছে।  

শশশশ.. হিসহিসিয়ে উঠলো হালস্টন। এক পলকে পাশে চেয়ে দেখলো শপিংব্যাগটা ছেঁড়া বা চিবোনো। আবার সামনে তাকিয়ে দেখলো বেড়ালটা থাবা উঁচিয়ে তারদিকে ছুঁড়ছে বারবার, সেই থাবা হালস্টনের কপালে এসে ঠেকছে। একটা ঝাঁকি দিয়ে ওটার আয়ত্ব থেকে মাথা সরিয়ে নিল সে, প্লাইমাউথের বিশাল টায়ার একদিক থেকে অন্যদিকে লাফিয়ে উঠল খানিকটা।

সে এক হাতের তালু দিয়ে ওটার সঙ্গে খেলতে চেষ্টা করলো। বেড়ালটা তাকে কিছু দেখতে দিচ্ছিলনা, দৃষ্টি ঢেকে দিয়েছিল, থুতু ছুড়ছিল, পিছন দিকটা ঘষে দিচ্ছিল তার হাতের চেটোয়, কিন্তু নড়ছিলনা যায়গা থেকে এক চুলও। হালস্টন আবার ওটাকে সরিয়ে দিতে চাইল, এবং সরে যাওয়ার বদলে বেড়ালটা লাফ দিয়ে পড়ল তার উপর।

গেজ, একদম গেজের সঙ্গে যা হয়েছিল- 

ব্রেক কষল সে। বেড়ালটা ছিল তার মাথায়। দু’চোখ ঢাকা পড়েছিল ওর লোমশ পেটের নিচে, সমানে খামচে চলেছিল। একহাতে ভয়ানকভাবে গাড়ির হাতলটা ধরে রেখে অন্যহাতে একবার, দু’বার, তিনবারের মত আঘাত করলো সে ওটাকে। এবং হঠাৎ অদৃশ্য হয়ে গেল রাস্তা। একটা পাথুরে খাতের মধ্য দিয়ে নিচে নামতে শুরু করলো প্লাইমাউথ। সকেট জাম্পারের উপর লাফাতে লাফাতে ঠোকর খেতে লাগলো। এরপর, প্রথম প্রতিক্রিয়া, তীব্র একটা ধাক্কা সিটবেল্ট প্রায় ছিঁড়ে সামনের দিকে নিয়ে ফেললো হালস্টনকে, শেষ যে শব্দ শুনতে পাচ্ছিল সে, বেড়ালটার পাশবিক কাতরানি, যেন প্রচন্ড বেদনা কাতর কোন নারীর চিৎকার অথবা কারও যৌনআনন্দের চুড়ান্ত মুহূর্তের প্রবল শীৎকার। 

বদ্ধ মুষ্টি দিয়ে একটা ঘুষি মারলো সে ওটাকে, টের পেল শুধু নরম কম্পমান ছোঁয়া করা যায়না এমন মাংসপেশি।   

এরপর এলো দ্বিতীয় ধাক্কা, গাঢ় অন্ধকারে ডুবে গেল চারধার।

চাঁদ ডুবে গিয়েছিল। ভোর হতে বাকি ছিল আর ঘন্টাখানেক।

একটা গিরিখাতের মাঝখানে দুমড়ে মুচড়ে পড়ে রইলো প্লাইমাউথটা, রাস্তার ধারের কাঁটাতার কষে পেঁচিয়ে বসেছে ওটার গায়ে। ধুলোয় ধুসর। র‍্যাডিয়েটর ফেটে ধোঁয়া উড়ছে।

তার পা দুটোয় কোন সাড় নেই।

নিচে তাকিয়ে সে দেখলো প্লাইমাউথের ফায়ারওয়াল ধ্বংস হয়ে গেছে। বিশাল সাইক্লোন ইঞ্জিনের ব্লক ভেঙে পড়ে আছে তার পায়ের উপর, পিনগুলো গেঁথে গেছে ভিতরে।    

বাইরে, দূর থেকে ভেসে এলো একটা প্যাঁচার ডানা ঝাপটাবার শব্দ, হয়ত ভীত সন্ত্রস্ত ছোট্ট কোন প্রাণীর উপর শিকারির ক্ষীপ্রতায় ঝাঁপিয়ে পড়ছে।

ভিতরে শুনতে পাওয়া যাচ্ছে শুধু বেড়ালটার শান্ত গরগরানি।

হাসছে ঠোট বাঁকিয়ে, ঠিক এলিস ইন দা ওয়ান্ডারল্যান্ডের চেশায়ার বেড়ালটার মত।

হালস্টন দেখলো উঠে দাঁড়িয়েছে প্রাণীটা, আড়মোড়া ভাঙলো আয়েশ করে। তারপর হঠাৎ করেই লাফ দিয়ে পড়লো তার ঘাড়ের উপর। ওটাকে সরাবার চেষ্টা করতে গিয়ে সে আবিষ্কার করলো, হাত দুটোও নাড়াতে পারছেনা।

সে ভাবলো, হবে এটা স্পাইনাল শক, কিছু সময়ের জন্য প্যারালাইজড হয়ে গেছে শরীর। ঠিক হয়ে যাবে।

বেড়ালটা ঝোড়ো ক্ষিপ্রতায় তার কানের কাছে গর্জাতে শুরু করলো। 

শুকনো কর্কশ কণ্ঠে হালস্টন খেঁকিয়ে উঠলো, ‘সরে যা আমার উপর থেকে, সরে যা।’ বেড়ালটা থেমে গিয়ে কিছু যেন ভাবলো একবার, পিছে সরেও গেল। তারপর আবার ঝাঁপিয়ে পড়লো তার উপর, থাবা বের করে দুগালে আঁচড়াতে থাকলো সমানে, তীব্র একটা যন্ত্রণা পৌঁছে গেল তার কণ্ঠনালী বরাবর, বেরিয়ে এলো উষ্ণ রক্তের ধারা।

যন্ত্রণা।

অনুভূতি।

নিজেকে সে আদেশ দিল, ডানে, ডানে ঘোরাতে হবে মুখটা, মস্তিষ্ক আদেশ কার্যকর করলো। তার মুখ ডুবে গেল শুকনো লোমে। বেড়ালটাকে কামড় দিল সে। চমকে উঠে সরে গেল ওটা একটু দূরে, রাগে গজরাচ্ছে। কানদুটো নুয়ে আছে পেছনের দিকে।

ককানো কণ্ঠে হালস্টন বললো, ‘এমনটা করতে চাইনি রে, চেয়েছিলাম বল?’

মুখ ফাঁক করে হিসহিসিয়ে উঠলো বেড়ালটা। অদ্ভুত, প্রায় সিজোফ্রেনিক পশুটার দিকে তাকিয়ে হালস্টনের স্মরণ হল ড্রোগানের কথা, ওটাকে সে বলেছিল নরকের বেড়াল।

তার চিন্তায় বাধ সাধল হাতে-পায়ে ফিরে আসা একটা বিমর্ষ অস্বস্তিকর অনুভূতি।

অনুভূতি ফিরে আসছে মানে পায়ে গেঁথে থাকা ইঞ্জিনের পিনগুলোর যন্ত্রণাও ফিরে আসবে।

বেড়ালটা আবার তার মুখের উপর এসে পড়লো। মুখ থেকে থুথু ছুটছে, বেরিয়ে আছে নখর, আঁচড়াতে শুরু করেছে।

হালস্টন চোখ বন্ধ করে বেড়ালটার পেটে কামড় বসিয়ে দিল, পশম ছাড়া আর কিছুই টের পেলোনা মুখে। সামনের থাবা দিয়ে তার কানদুটো আঁকড়ে ছিল ওটা, খুঁড়ে চলেছে। সহ্যের অতীত যন্ত্রণা হচ্ছিল তার। হাত উঁচিয়ে ওটাকে থামাতে চেষ্টা করলো সে, হাতদুটো একটুও নড়লোনা কোলের উপর থেকে।

সে অনবরত নিজের মাথাটা আগুপিছু করতে শুরু করলো যেভাবে কেউ চোখের উপর থেকে সাবানের ফেনা সরাবার চেষ্টা করে। কিন্তু বেড়ালটা এক ইঞ্চি নড়লোনা। বুঝতে পারছিল তার গালের উপর থেকে গড়িয়ে পড়ছে উষ্ণ রক্তের ধারা। শ্বাস নিতে পারছিলনা কেননা নাকের উপরেই চেপে আছে ওটার বুক। মুখ হাঁ করে তবু কিছুটা দম নেয়া গেল, কিন্তু মুখের ভিতরটা ভরে গেল লোমে। মনে হচ্ছিল কানদুটোয় যেন কেউ বারুদ ঠেসে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে।

পিছন দিকে মাথাটা রেখে মৃত্যুযন্ত্রণায় চিৎকার করে উঠলো হালস্টন। সে এত আহত হয়েছে দুর্ঘটনায়, বেড়ালটার কিছু হলনা কেন? ওটাও তো বেরোতে পারেনি প্লাইমাউথের ভিতর থেকে। চোখের উপর এসে পড়ছিল রক্তের ধারা, হাত উঁচিয়ে তা মুছবার চেষ্টা ব্যার্থ চেষ্টা করলো হালস্টন। ওদুটো তার কোলে পড়ে থেকেই কাঁপছে। শোল্ডার হোলস্টারে নিজের .৪৫ স্পেশালটাকে অনুভব করলো সে। 

‘অস্ত্রটা যদি ধরতে পারি, কিটি, একবারেই তোর নয়টা জীবন শেষ করে ফেলব আজ।’   

হালস্টন কেঁপে কেঁপে উঠছিল যন্ত্রণায়। যেভাবে ঘুম ভাঙ্গবার পর অঙ্গপ্রত্যঙ্গে সাড়া ফিরে আসে, ওভাবে তার পায়ে একটা প্রচণ্ড ব্যাথা জেগে উঠতে শুরু করলো। কিন্তু পায়ের দিকে মনযোগ দিলনা সে। মেরুদণ্ড যে ভাঙেনি, বাকি জীবনটা যে একটা অসাড় দেহে কথাবলা যন্ত্র লাগিয়ে চলতে হবেনা, এটুকুও স্বস্তি দিচ্ছিল তাকে।

হয়ত আমারও কয়েকটা জীবন বাকি আছে।

বেড়ালটার ব্যবস্থা করতে হবে সবার আগে। তারপর চেষ্টা নিতে হবে প্লাইমাউথ থেকে বেরুবার। কেউ না কেউ নিশ্চয় তাকে দেখে এগিয়ে আসবে সাহায্য করতে। কিন্তু ভোর সাড়ে চারটায় এমন একটা উল্টোপথে কেই বা আসবে? তবু সম্ভাবনা যে একদম নেই তাও না .. আর- 

আচ্ছা বেড়ালটা কী করছে এখন? কোথায় গেল ওটা?  

মুখের উপর থেকে সে ওটাকে সরাতে চাইছিল, কিন্তু হালস্টন এও চাইছিলনা যে বেড়ালটা তার চোখের আড়াল হোক। ব্যাকভিউ মিররের সন্ধানে উপরদিকে চাইলো সে, অক্ষত নেই জিনিসটা, ভেঙ্গে গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে হয়ত ছড়িয়ে পড়েছে আশপাশের ঘেসো জমিতে।  

তখন পিছন থেকে এলো শব্দটা। 

গরগর গরররগর।

নরকের বিলাই না ছাই। ঘুমিয়ে পড়েছে ওটা।

যদি নাও ঘুমায়, যদি তাকে মারতেই চায়, কী যায় আসে। ছোট্ট একটা জিনিস, চার পাউন্ডও হবেনা ওজন। একটা সময় ঠিকই তার হাতে জোর ফিরে আসবে। হালস্টন নিশ্চিত ছিল।

পুবের আকাশে একটা সূক্ষ্য আলোর রেখা ধরা পড়লো চোখে। কোথাও গান গেয়ে উঠলো একটা পাখি।

হালস্টন প্রবল চেষ্টায় নাড়াতে চেষ্টা করলো তার হাত, এক ইঞ্চির আট ভাগের একভাগ মতন নড়লোও, কিন্তু পড়ে রইলো তার কোলের উপরেই।

আসবে আসবে। দ্রুতই শক্তি ফিরে আসবে ওগুলোয়।

ধপাস করে একটা শব্দ হল সিটের পেছনে। সে মাথা ঘুরিয়ে দেখল সাদা-কালোয় ভাগ করা মুখটায় কালো দুটো চোখের মণি জ্বলজ্বল করছে। 

‘গুলি করে কখনও কারও খুলি উড়িয়ে দেইনি এর আগে আমি, বুঝলি কিটি? এইটা হবে প্রথমবারের মত। কিছুক্ষণের মাঝেই হাত নাড়াতে পারব আমি। পাঁচ মিনিট, বড় জোর দশ মিনিট। আমার পরামর্শ চাস? জানালা খোলা আছে, সময় থাকতে এখনই পালা। মনে করে সঙ্গে তোর লেজটাও নিয়ে যা।’

বেড়ালটা চেয়ে রইলো নির্নিমেষ।

হালস্টন আবার হাত নাড়াতে চেষ্টা করলো। এবার কিছুটা উঠে এলো, কাঁপছে ভীষণভাবে, হবে, এভাবেই হবে। ওদের বিশ্রাম দিতে আবার কোলের উপর পড়ে থাকতে দিল। যেন একজোড়া গ্রীষ্মমণ্ডলীয় মাকড়সা, ফ্যাকাসে আর উজ্জ্বল।

বেড়ালটা ভেংচি কাটছিল তাকে।

কোন ভুল কি হয়ে গেল? ভেবে পেলনা হালস্টন। নইলে অমন করবে কেন ওটা? যেন চুড়ান্ত আঘাতের আগে প্রস্তুতি নিচ্ছে। আবার লাফ দিয়ে তার উপর পড়বার আগেই বেড়ালটার উদ্দেশ্য বুঝতে পেরে চেঁচাতে শুরু করলো হালস্টন।

তার জঙ্ঘার উপড়ে থাবা গেড়ে বসেছে ওটা, নখ বের করে আঁচড়াতে শুরু করেছে।

সে মুহূর্তে তার মনে হল কেন সে প্যারালাইজড হয়ে নেই। এমন দানবীয় যন্ত্রণাও যে মানুষের হতে পারে, তার কোন ধারণা ছিলনা। যেন একটা স্প্রিং এর আগুনে গোলা তার অণ্ডকোষও খামচে ছিঁড়ে ফেলছে।

গাল হাঁ করে আর্তনাদ করছিল হালস্টন। ঠিক তখনই দিক বদলে বেড়ালটা তার খোলা মুখের উপর ঝাঁপ দিল, মাথাটা ঢুকিয়ে দিল ভিতরে। সে মুহূর্তেই তার মনে হল, সাধারণ কোন বেড়াল হতে পারেনা এটা। এমন অশুভ, এমন খুনে .. শেষবারের মত সাদা-কালোয় ভাগ করা মুখটা সে দেখতে পেল। বড় বড় দুটি চোখ জ্বলছে উন্মাদ ঘৃণায়।  বুড়োগুলোর হাত থেকে ওটা নিস্তার পেয়েছিল, এখন নিস্তার পেতে যাচ্ছে জন হালস্টনের হাত থেকে।

বেড়ালটা চুড়ান্ত আঘাত হানছিল তার মুখের ভিতরে। কণ্ঠরোধ হয়ে আসছিল। সামনের দুই থাবায় চিড়ে দিচ্ছিল কণ্ঠনালী, জিভটা ধারালো নখরে ফালাফালা করে দিচ্ছিল যেন এক টুকরো কলিজা। সহ্য করতে না পেরে বমি করে দিল হালস্টান। সেই বমি বাইরে বেরুতে না পেরে কণ্ঠনালী দিয়ে আবার ঢুকে পড়লো গলার ভিতরে, দম প্রায় বন্ধ হয়ে এলো তার।

এই অন্তিম অবস্থায় শেষ চেষ্টা হিসেবে সে একটা দুর্বল হাতে ধরতে চেষ্টা করলো বেড়ালটাকে, পারলোনা। কোনমতে বলে উঠলো, ও ঈশ্বর .. 

বেড়ালটা তার মুখের ভিতর ঢুকে পড়ছিল ক্রমশ। শরীরটাকে কুঁচকে, ছোট করে, যেভাবেই হোক। যায়গা করে দিতে তার চোয়াল প্রসারিত হচ্ছিল ধীরে ধীরে। ওটাকে টেনে বের করে খুন করতে হাত বাড়াল সে আবার, শুধু একবার কোনরকমে লেজটা ছুঁতে পারলো।

কোন একভাবে বেড়ালটা তার পুরো শরীর নিয়ে ঢুকে পড়ল হালস্টনের মুখের ভিতরে। 

একটা যন্ত্রণাকাতর ধ্বনিতে ভরে উঠল চারধার। তার গলা থেকে বেরিয়ে এলো হড়হড়হড় শব্দ, হোস পাইপের ভিতর বাতাস ঢুকে গেলে যেমন শোনা যায়। শরীরটা মুচড়ে উঠলো, হাতদুটো কোলের উপর গেল ফিরে, উরুর উপর আঙ্গুলগুলো বাড়ি খেতে লাগলো এলোমেলো। দৃষ্টিশূন্য চোখ দুটো ঠেলে বেরিয়ে এসে চেয়ে রইল উইন্ডশিল্ডের ওপাশে ভোরের প্রথম আলোর দিকে। 

তার মুখের বাইরে তখনও একটা সাদাকালো চেকচেক লেজ বেরিয়েছিল ইঞ্চি দুয়েকের মত, নড়ছিল এদিক-ওদিক।

অতঃপর ওটা পুরোপুরি অদৃশ্য হয়ে গেল।

উইল রিউস কানেক্টিকাটের স্থানীয় কৃষক। নভেম্বরের উজ্জ্বল সকালটায় প্লেসার্স গ্লেনের দিকে যাচ্ছিল সে, খামারের ট্রাকে নতুন ইন্সপেকশন স্টিকার লাগাতে হবে। তখন চোখে পড়লো, অদূরেই গিরিখাতটার ওদিক থেকে সূর্যের আলোতে কিছু একটা চকচক করছে, কী ওটা? ট্রাক থেকে নেমে একটু সামনে এগোতেই নিচের দিকে পড়ে থাকা প্লাইমাউথটা নজরে এলো। কাঁটাতারে উৎকটভাবে পেঁচিয়ে আছে, বিধ্বস্ত। 

সাবধানে নিচে নেমে যা দেখল, বিস্ময় আর আতঙ্কে নিঃশ্বাস বন্ধ হবার উপক্রম হল তার। চালকের আসনে সিটবেল্ট বাঁধা অবস্থায় একটা লোক বসে আছে, প্রাণহীন চোখদুটি চেয়ে আছে অনন্তের দিকে। সারা মুখে লেপ্টে আছে রক্ত।

দু’হাত লাগাবার পরেও জ্যাম হয়ে থাকা দরজা খুলতে বেগ পেতে হল। ভিতরের দিকে ঝুঁকে পড়ে সিটবেল্ট থেকে লাশটিকে মুক্ত করলো রিউস, উদ্দেশ্য কোটের পকেট থেকে যদি আইডি কার্ড জাতীয় কিছু উদ্ধার করা যায়। হঠাৎ সে টের পেল, লাশটির কোমরের কাছটায় ঢেউ খেলে যাচ্ছে, একবার উঁচু হচ্ছে, আবার স্বাভাবিক হচ্ছে মুহূর্তে, বেল্টের ওখানটা উঠছে ফুলে। আজব তো! রক্তে ভরে উঠছে যায়গাটা যেন সেখানে একটা অশুভ গোলাপ ফুটবে।

‘জেসাস ক্রাইস্ট, কী হচ্ছে এসব?’ লাশটির শার্ট উঁচুতে তুলে দিল সে।

হালস্টনের নাভির মাংস ছিন্নভিন্ন করে তৈরি হল একটা গর্ত। সেই গর্তের ওপাশে দেখা দিল রক্তমাখা সাদা-কালো একটা বেড়ালের মুখ, জ্বলছে ওর বড় বড় চোখদুটো। 

এক ঝটকায় পিছে সরে এলো উইল রিউস, কাঁপতে থাকা দুহাতে মুখ ঢাকলো। ও ঈশ্বর .. কাছাকাছিই মাঠের উপরে একদল কাক সমস্বরে ডাকতে শুরু করলো তখন। 

হালস্টনের পেটের ভিতর থেকে বেরিয়ে এলো বেড়ালটা, অসহ্য এক ধীর গতিতে আড়মোড়া ভাঙলো। তারপর প্লাইমাউথের ওপাশের জানালা দিয়ে বেরিয়ে গেল এক লাফে। সে দেখল লম্বা লম্বা মৃত ঘাসের জঙ্গলে ওটাকে অদৃশ্য হয়ে যেতে। 

পত্রিকার রিপোর্টারকে বলেছিল রিউস, ‘দেখে মনে হচ্ছিল ওর যেন খুব তাড়া আছে কোথাও যাবার। যেন তখনও একটা অসমাপ্ত কাজ বাকি রয়ে গেছে।’  


প্রচ্ছদ চিত্র: Wakoo22, Japan

11 thoughts on “নরকের বেড়াল | স্টিফেন কিং | ভাষান্তর- এনামুল রেজা

  1. দুর্দান্ত গল্প, নিখুঁত অনুবাদ। অনুবাদ বলে কোথাও মনে হয়নি। শ্রমসাধ্য এমন একটা কাজের জন্যে অনুবাদককে অনেক ধন্যবাদ।

    Liked by 1 person

    • খুবই আনন্দিত হলাম আপনার মতামত পেয়ে। ভাল থাকবেন। শুভকামনা।

      Liked by 1 person

  2. অনুবাদে আপনার বুৎপত্তি ও শক্তিমত্তা লেখাটার জায়গায় জায়গায় আমাকে যুগপৎ মুগ্ধ ও বিস্মিত করেছে।

    আরও এমন লেখা আশা করছি। ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন, আনন্দে থাকুন।

    Liked by 1 person

  3. হুবহু এই অনুবাদ প্রকাশিত হয় ২০১৯ সালে জুলাই মাসে কলকাতা থেকে প্রকাশিত ‘পরবাসিয়া পাঁচালি’ নামের একটি অনলাইন সাহিত্য ম্যাগাজিন। স্টিফেন কিংয়ের ‘দ্যা ক্যাট ফ্রম হেল’ শিরোনামে সাইকোলজিক্যাল হরর গল্পটির অনুবাদ (রূপান্তর) করেছেন অপরেশ পাল। কেবল শিরোনাম পাল্টে ‘নরকের বিড়াল’ নামে গল্পটির হুবহু ওয়ার্ড টু ওয়ার্ড একই বছরের অক্টোবরে প্রকাশ করে এর অনুবাদক হিসেবে নিজেকে দাবি করছেন এনামুল রেজা। একই গল্প অনুবাদ বা ভাষান্তরে কিছুটা সমিল থাকতেই পারে। কিন্তু তাই বলে দাঁড়ি কমাসহ সবকিছুই একরকম। এ হতেই পারে না। ব্যাখা করবেন এনামুল রেজা।

    https://www.parobashiapachali.in/2019/07/cat-from-hell.html

    Liked by 1 person

    • বিস্মিত এবং হতবাক হলাম প্রথমে। এবার সুন্দর করে ব্যাখ্যা দিচ্ছি। নিজের রাগ সামলে।

      আমার অনুবাদটাই চুরি করে নিজেদের পত্রিকায় ছাপিয়েছে এরা। আপনি মন্তব্য না করলে জানাও হতনা। এই গল্পের অনুবাদ আমি করেছি ২০১৮ সালে। ঐ পত্রিকা বা লেখকই যে চুরি করেছে তা প্রমাণ করতে সময় খরচ করে নিজের প্রাইভেট করে দেওয়া সাব ডোমেনের ওয়ার্ডপ্লেস ব্লগটা আবার পাবলিক করলাম। enamulreza.wordpress.com -এ এই গল্প আমি পাবলিশ করেছি ২১শে সেপ্টেম্বর ২০১৮ সালে। আর এই চোর পত্রিকা বা অনুবাদক তা ছেপেছেন আপনার দাবিমত ২০১৯ এর অক্টোবরে বা জুলাইয়ে। কাইন্ডলি এই চোর লেখকটিকে ধরুন গিয়ে একজনের শ্রম আর মেধার উপর আঙুল তোলার আগে।

      নরকের বেড়াল প্রথম প্রকাশনার লিংক –
      https://enamulreza.wordpress.com/2018/09/21/the-cat-from-hell-bengali-translation/

      আর আমার নতুন লেখা ঐ পত্রিকা বা লেখক চুরি করত করতে চাইলে নতুন ওয়েবসাইটের ঠিকানা রইল – enamulreza.com

      আর এই ফেসবুক পোস্ট থেকেও ঘুরে আসবেন। তারিখ, রিএকশন মন্তব্যসহ ধরা আছে ২০১৮ সালে। 🙂 https://www.facebook.com/search/posts?q=%E0%A6%A8%E0%A6%B0%E0%A6%95%E0%A7%87%E0%A6%B0%20%E0%A6%AC%E0%A7%87%E0%A7%9C%E0%A6%BE%E0%A6%B2&filters=eyJycF9hdXRob3IiOiJ7XCJuYW1lXCI6XCJhdXRob3JfbWVcIixcImFyZ3NcIjpcIlwifSJ9

      Like

  4. অন্যের অনুবাদ করা লেখা চুরি করে নিজের নামে চালিয়ে মহাপথে কি হাঁটা যায়। চৌর্যবৃত্তির এই মহান কাজটা করে প্রতিবেশী দেশে বাংলাভাষিদের কাছে বাংলাদেশের লেখক/অনুবাদকদের ছোট করেছেন এনামুল রেজা। ২০১৯ সালের ৩১ অক্টোবর “স্টিফেন কিংয়ের গল্প ‘নরকের বিড়াল’ ভাষান্তর- এনামুল রেজা” মহাপথে প্রকাশ করায় তীব্র ঘৃণা নিন্দা জানাচ্ছি।

    মহাপথে চৌর্যবৃত্তির মহানকর্মের তীব্র প্রতিবাদ ও ঘৃণা।

    ২০১৯ সালে জুলাই মাসে কলকাতা থেকে হুবহু এই অনুবাদ গল্প প্রকাশিত হয় ‘পরবাসিয়া পাঁচালি’ নামের একটি অনলাইন সাহিত্য ম্যাগাজিন। স্টিফেন কিংয়ের ‘দ্যা ক্যাট ফ্রম হেল’ শিরোনামে সাইকোলজিক্যাল হরর গল্পটির অনুবাদ (রূপান্তর) করেছেন অপরেশ পাল। কেবল শিরোনাম পাল্টে ‘নরকের বিড়াল’ নামে গল্পটির হুবহু ওয়ার্ড টু ওয়ার্ড একই বছরের অক্টোবরে প্রকাশ করে এর অনুবাদক হিসেবে নিজেকে দাবি করছেন এনামুল রেজা। ছি:।

    লিংক: https://www.parobashiapachali.in/2019/07/cat-from-hell.html

    Like

    • চাপা মারার যায়গা পান না? আমার অনুবাদটাই চুরি করে নিজেদের পত্রিকায় ছাপিয়েছেন আপনারা। এই গল্পের অনুবাদ আমি করেছি ২০১৮ সালে। আপনাদের চুরি প্রমাণ করতে সময় খরচ করে নিজের প্রাইভেট করে দেওয়া সাব ডোমেনের ওয়ার্ডপ্লেস ব্লগটা আবার পাবলিক করলাম। দেখে আসেন আর ক্ষমা চেয়ে যান। enamulreza.wordpress.com -এ এই গল্প আমি পাবলিশ করেছি ২১শে সেপ্টেম্বর ২০১৮ সালে। আর আপনারা ছেপেছেন আপনাদের দাবিমত ২০১৯ এর অক্টোবরে বা জুলাইয়ে। কাইন্ডলি আপনাদের চোর লেখকটিকে ধরুন গিয়ে একজনের শ্রম আর মেধার উপর আঙুল তোলার আগে। ইডিয়টের দল।
      নরকের বেড়ালঃ
      https://enamulreza.wordpress.com/2018/09/21/the-cat-from-hell-bengali-translation/

      আর আমার নতুন লেখা চুরি করতে চাইলে আমার নতুন ওয়েবসাইটের ঠিকানা রইল। enamulreza.com

      আর এই ফেসবুক পোস্ট থেকেও ঘুরে এসো। তোমাদের মত হাফউইটদের আর আপনি বলারও দরকার বোধ করিনা। এটা ও ২০১৮ সালের পোস্ট। https://www.facebook.com/search/posts?q=%E0%A6%A8%E0%A6%B0%E0%A6%95%E0%A7%87%E0%A6%B0%20%E0%A6%AC%E0%A7%87%E0%A7%9C%E0%A6%BE%E0%A6%B2&filters=eyJycF9hdXRob3IiOiJ7XCJuYW1lXCI6XCJhdXRob3JfbWVcIixcImFyZ3NcIjpcIlwifSJ9

      Like

      • আপনার অবগতির জন্য জানাচ্ছি, আমি parobashiapachal পত্রিকার কেউ না। একজন পাঠক এবং সাহিত্য অনুরাগী। একই গল্পের অনুবাদ ভিন্ননামে দুই জায়গায় দেখার পর প্রশ্ন জাগাটাই স্বাভাবিক। মহাপথে প্রকাশিত আপনার অনুবাদকৃত গল্পটি হুবহু পরবাসিনী পাঁচালিতে চোখে পড়ে এবং মহাপথে প্রকাশের তারিখ থেকে ওদের প্রকাশের তারিখ আগে, সেজন্যই বিষয়টি তুলে ধরা। আপনার অনুবাদটি কবে প্রথম প্রকাশিত হয়েছে তা আমার জানা ছিল না। আপনার উচিত ওই পত্রিকায় অপরেশ পাল নামক অপলেখকের চৌর্যবৃত্তির কঠোর প্রতিবাদ জানানো। পাশাপাশি আমি মনে করি, একজন লেখক হিসেবে আপনার আচরণ ও বক্তব্য সংযত এবং সহনশীল হওয়া উচিত। ধন্যবাদ।

        Like

      • চৌর্যবৃত্তির যথার্থ প্রতিবাদ জানানো হয়েছে। চোর ক্ষমা চেয়ে ফেসবুক একাউন্ট ডিএকটিভ করেছে। আর পত্রিকাটির সম্পাদক ভদ্রলোক, পাবলিক পোস্টে আমার কাছে ক্ষমা চেয়েছেন। আপনি আমার বক্তব্য শোনার আগেই আমাকে ছিঃ ছিঃ জানিয়েছিলেন, মানেই ধরেই নিয়েছিলেন আমি চোর। প্রমাণ দেয়ার পর এখন কান্না করা হচ্ছে? ভদ্রলোক হলে আপনিও ক্ষমা চাইতেন নিজের নিন্দনীয় মন্তব্যের জন্য। আপনার আচরণ ছিল বিশ্রী এবং নিন্দনীয়, সেটার জবাবে আমি যথেষ্ট ভদ্র আচরণ করেছি। লজ্জা থাকলে আর মন্তব্য করতেন না। আপনার ধন্যবাদের প্রয়োজন নেই আমার। এবং আপনার মত মূর্খ ও টক্সিক কারও থেকে শিষ্টাচার শেখারও কিছু নেই। ফাক অফ।

        Like

      • had no way of knowing which one was published earlier. Your behavior proved that you are basically a bastard.

        Like

  5. I had no way of knowing which one was published earlier. Your behavior proved that you are basically a bastard.

    Like

Leave a reply to protimuhurto প্রতিমুহূর্ত Cancel reply