১
ডিস্টোপিয়ান সাহিত্য পশ্চিমা দেশগুলোয় খুব জনপ্রিয়। এ ধরণের লেখায় গল্পকে নিয়ে যাওয়া হয় সুদূর কিংবা অদূর ভবিষ্যতে, এবং নিশ্চিতভাবেই মানব সভ্যতার নানা রকম দুর্যোগ আঁকা হয়। কেউ কেউ আবার ওই ভবিষ্যৎকে যোগ করেন অতীতের কোন অন্ধকার ঘটনা বা কালে।
যদিও বর্তমান ও অতীত সংকটের ছায়াকে রূপকে প্রকাশ করে জগতে বহু সাহিত্য রচিত হয়েছে। বিশেষ করে গত শতকের চিরায়ত উপন্যাসগুলোর দিকে তাকালে দেখি (ধরা যাক, কাফকার দা ট্রায়াল থেকে কুন্ডেরার দা আনবিয়ারেবল লাইটনেস অব বিয়িং) মানুষের চলমান অস্তিত্ব সংকট ও পতনোন্মুখ সময়ের গল্পই শোনায়। কাঠামো ও প্রকাশভঙ্গির বিবেচনায় এগুলোকে ডিস্টোপিয়ান উপন্যাস বলা যাবেনা। তবে ক্ষয়প্রাপ্ত পৃথিবীর আশাহীনতার জান্তব আখ্যানগুলো আমাদের কি অন্যকিছু ভাবতে দেয়?
হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাস ‘কে কথা কয়’ হচ্ছে এই দ্বিতীয় দলের অন্তর্ভুক্ত। যা বর্তমানে দাঁড়িয়ে থাকা বাংলাদেশের সামাজিক ও মানবিক দূর্যোগপ্রবণতাগুলো চিত্রণের চেষ্টা করে।
২
আমি যেহেতু ডিস্টোপিয়ার মত শব্দ দিয়ে লেখাটা শুরু করেছি, এর সহজ মানে হল: বিশৃংখলার শীর্ষে থাকা একটা সমাজ। একইভাবে এর বিপরীত রূপটি সকল মানুষের কাম্য: ইউটোপিয়া, যার মানে চারদিকে ভারসাম্য ও সমৃদ্ধিময় এক সমাজ। উপন্যাস যেহেতু মানব সংকটের সকল দিক নিয়ে কাজ করতে আগ্রহী, তার ক্ষেত্রে এ দুটি শব্দ বিভিন্ন আকার নিয়ে ঘোরাফেরা করতে পারে।
৩
ভূমিকায় হুমায়ূন আমাদের জানাচ্ছেন, তিনি এ বই লিখবার মন্ত্র পান মার্কিন সাহিত্যিক ক্যারেন আর্মস্ট্রং এর আত্মজৈবনিক “দ্যা স্পাইরাল স্টেয়ারকেস” থেকে। যেখানে লেখিকা এক অটিস্টিক শিশুর কথা বলেন, এক সময় শিশুটির বেবিসিটারের দায়িত্ব পালন করতেন তিনি।
এরপর আছে মার্ক হ্যাডনের উপন্যাস “দা কিউরাস ইনসিডেন্ট অফ দা ডগ ইন দা নাইট টাইম” এর উল্লেখ। এ বইটির পনেরো বছর বয়সি মূল চরিত্র নিজেকে দাবি করে একজন গণিতবিদ হিসেবে, যে স্বীকার করে তার কিছু মানসিক সমস্যাও আছে।
ভূমিকার এ কথাগুলো খুব গুরুত্বপুর্ণ কারণ “কে কথা কয়” উপন্যাসের মূল চরিত্রের একজন কমল, যার বয়স দশ-এগারো, অটিস্টিক শিশু এবং গণিতে আগ্রহী।
সম্ভবত হুমায়ূন তার গল্প সূচনার প্রধান ঘুটি হিসেবে কমলকে নেন, ব্যক্তি জীবনেও এরকম মানসিক প্রতিবন্ধি শিশু তিনি দেখেছেন ভূমিকা থেকে তাও জানা যায়। অবশ্য গল্প শুরু হয় মতিন নামের সাতাশ বছর বয়সি এক বেকার যুবককে দিয়ে। কমলের সার্বক্ষণিক সঙ্গী হিসেবে সে চাকুরি নিতে আসে। চাকরি পেয়েও যায় এবং প্রথম সাক্ষাতে কমল মতিনকে পছন্দ করেনা।
ধীরে ধীরে আবিষ্কার হয় মতিন নিজেও কমলের চে’ আলাদা কেউ না, কমলের অনেক বিষয় তার সাথে মিলে যাচ্ছে। অটিজমে আক্রান্ত শিশুরা অকারণ কোমল কিংবা অকারণ নিষ্ঠুর হতে পারে, মতিন নিজের মাঝে এসমস্ত ব্যাপার আবিষ্কার করে, আদতে পাঠককে সাথে নিয়েই।
৪
পারস্পরিক কতগুলো চরিত্র নিয়ে এ উপন্যাসের চাকা ঘুরতে থাকে। আমরা কয়েক ধরণের মানুষের দেখা পাই। এরা সমাজের বিভিন্ন স্তরে বসবাস করলেও একেবারে প্রান্তিক কেউ নেই।
কমল: দশ এগারো বছর বয়সি এক অস্টিস্টিক শিশু। যদিও তার অটিজমের ক্ষেত্রটি রহস্যময়। একগুঁয়েমি ও নিজের একান্ত জগতের বাইরে সে চিন্তা করেনা। যুক্তিহীনতা ও মিথ্যে তাকে রাগিয়ে দেয়। গণিতে প্রচন্ড আগ্রহী। ডাইলেক্সিক, অর্থাৎ বর্ণমালা উল্টো দিক থেকে পড়ে বা বুঝতে পারে।
মতিন: টিপিকাল হুমায়ূনিয় যুবক তাকে মনে হবে প্রথম দর্শনে। যদিও পরবর্তি সময়ে দেখা যাবে সে নিজের অজান্তেই মানসিক প্রতিবন্ধিদের একজন।
কমলের বাবা-মা: সালেহ ইমরান একজন ব্যারিস্টার। বিত্তশালী। রূপবতি স্ত্রী মুনাকে তিনি ভালবাসেন বলেই তার ধারণা। মুনা নিজেও একজন বিত্তশালী নারী। মানসিক অবসাদগ্রস্ত। ইমরানের থেকে দিনের পর দিন যার মানসিক ও শারিরিক দুরত্ব বাড়ছে। অর্থনৈতিকভাবে ডিপ্রাইভড শ্রেণীর চোখে এই বিত্ত-বৈভবের মাঝে বসবাস করাটা ইউটোপিয়া।
আহমেদ ফারুক: সালেহ ইমরানের জুনিয়র সহকর্মী এবং তার পার্সোনাল এসিস্ট্যান্ট। সুদর্শন ও চটকদার চরিত্র। মুনার সাথে তার গোপন সম্পর্ক থাকবার ইঙ্গিত আছে উপন্যাসের শুরুর দিকে।
নিশু: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজী সাহিত্যে সদ্য মাস্টার্স করা তরুণী। উপর দিয়ে দেখা যায় তার মাঝে রমণীয় কোমলতা নেই। খুব মেধাবী ছাত্রী। ইংল্যান্ডে পিএচডি করতে যাবে কমনওয়েলথ স্কলারশিপ নিয়ে।
আজিজ আহমেদ: নিশুর বাবা। স্ত্রী মারা গেছেন এবং মেয়েকে সাথে নিয়ে মোটামুটি নিঃসঙ্গ জীবনযাপন করেন।
সালেহা: মতিনের বড় বোন। ভয়ানক পেটের পীড়ায় আক্রান্ত, বছরের অধিকাংশ সময় অসুস্থ থাকেন।
হাবিব: আর্থিকভাবে সচ্ছল ছা-পোষা মানুষ, সালেহার স্বামী।
তৌহিদা: হাবিবের দুঃসম্পর্কের বোন। মতিনের বিষয়ে মেয়েটির ভয়ানক দুর্বলতা আছে। মতিনকে সে বিয়ে করবে, সুখের সংসার হবে এরকমের স্বপ্ন সে দেখে। কলেজ পড়ুয়া এক সরলমনা তরুণী স্বাভাবিকভাবেই এখানে তার শ্রেণীর প্রতিনিধিত্ব করে।
নদ্দিউ নতিম: কাল্পনিক উজবেক কবি। মতিনের মস্তিষ্ক থেকে সৃষ্ট। নদ্দিউ নতিমের একটি কবিতা এইরকম: জলে কার ছায়া পড়ে কার ছায়া জলে/ সেই ছায়া ঘুরেফিরে কার কথা বলে/ কে ছিল সেই শিশু কী তাহার নাম/ নিজের ছায়ারে তার করিছে প্রণাম।
আশরাফ: মতিনের বন্ধু। পাহাড়ি অঞ্চলে জমি লিজ নিয়ে সে তৈরি করেছে তার আপন সাম্রাজ্য। মোটামুটি প্রকৃতির কোলে আদিম ধরণের আনন্দময় জীবন সে পার করে, মতিনকে মাসোহারা দেয়, নিয়মিত চিঠি লেখে।
৫
মূল চরিত্রগুলোর পাশে ছোটখাটো আরও অজস্র চরিত্রের সমাবেশ আছে কিন্তু আখ্যান নানা রকমের এ্যাক্ট করে এদেরকে ঘিরেই। মতিন আর কমলের ঘটনাগুলো এগিয়ে যায় সামনের দিকে। সালেহ ইমরান ও মুনার সম্পর্কের মাঝে তৃতীয় ব্যক্তি হিসেবে প্রকট হয় আহমেদ ফারুক।
নিশু আর তার বাবার সঙ্গে মতিন প্রায়ই দেখা করতে আসে। শুরুর দিকে নিশু মোটামুটি চুক্তিভিত্তিক বিয়ের প্রস্তাব দেয় মতিনকে। মতিন সেটিতে রাজি হয়না, ব্যাস্ত থাকে তার মস্তিষ্ক প্রসূত উজবেক কবিকে নিয়ে। তার নামে সে কবিতা লেখে, পত্রিকায় প্রবন্ধ ছাপায়, এমনকি “নদ্দিউ নতিমের নিষিদ্ধ গল্প” নামক পাণ্ডুলিপি রেডি করে বই প্রকাশে প্রকাশককে রাজি পর্যন্ত করিয়ে ফেলে। আমরা লেখক মারফত জানতে পারি, নতুনদের মৌলিক বই না ছাপালেও অনুবাদ বই ছাপাতে প্রকাশকেরা খুব আগ্রহী থাকেন। যদিও পরবর্তিতে দেখা যায় নিশুর সাথে মতিনের সম্পর্কটা নিছক বন্ধুত্বের চে’ও বেশি, তারা একে অন্যকে পছন্দ করে, হয়ত ভালোও বাসে।
মতিনের সাথে বিয়ে ঠিক হয় তৌহিদার, অথচ বিয়ের দিন সে চিরকুট পাঠায়—বিয়ে করতে পারবেনা। আখ্যানটি পাঠককে স্বস্তি দিতে নাকচ করে এ পর্যায় থেকেই।
দেখা যায়, অটিজমে আক্রান্ত কমল যতটা বিকারগ্রস্থ, সমাজে সুস্থ-স্বাভাবিক বলে পরিচিত মানুষেরা আরও বেশি মাত্রায় অসুস্থ। মতিন একেবারে অকারণেই তৌহিদার সঙ্গে নিজের বিয়েটা ভেঙে ফেলে। ঘটনাটি মতিনের পরিবারকে এলোমেলো করে দেয়। তার বড় বোন সালেহা নিজের স্বামী হাবিবকে বাধ্য করেন তৌহিদাকে বিয়ে করতে। প্রাথমিকভাবে হাবিব রাজি না থাকলেও স্ত্রীর চাপে এ কাজ করতে বাধ্য হন। পালিত বোনের সাথেই বিয়েতে বসেন। এবং এক সকালে তৌহিদা উন্মাদ্গ্রস্থা হয়ে বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে পড়ে নিরুদ্দেশ। হারিয়ে যায়।
নিশুর বাবা আজিজ আহমেদের মৃত্যুতে ঢাকা মহানগরিতে একাকি একটা মেয়ের বসবাস জটিলতা প্রকট হয়। এবং ডিস্টোপিয়ার চিহ্ন স্বরুপ এলাকার কিছু বখাটে যুবক একদিন ঘরে ঢুকে নিশুকে ধর্ষণ করে। এখানে ধর্ষণের জান্তব বর্ণনা লেখক দেননা, কিন্তু মানবতার বেদনাবোধটি টের পেতে পাঠকের কোন সমস্যা হয়না। সবচে’ বেশি যা হয়, পাঠক এক স্থায়ি অস্বস্তিতে পড়ে, কী হচ্ছে এসব?
উপন্যাসের সবচে’ বুদ্ধি বৃত্তিক চরিত্র সম্ভবত কমল। গল্পের এক পর্যায়ে সে এক অন্ধকার পারিবারিক সত্য আবিষ্কার করে। সে একটি ভয়ানক সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়।
৬
বাংলাদেশের সমাজ যে অবস্থায় এসে দাঁড়িয়ে আছে—শিক্ষার মৌলিক গুরুত্ব শুধু আর্থিক স্বার্থে ঠেকে যাওয়া, সমাজের প্রতিটি স্তরে অপরাধ প্রবণতার ফ্লাড, মানুষের সমাজ বিচ্ছিন্নতা ও একেবারে ঐকান্তিক নিজস্ব স্বপ্নবাস্তবায়নে সামষ্টিক উন্নয়নকে তুচ্ছ করতে মরিয়া হয়ে ওঠা—সবকিছুই তো মূলত সামাজিক বিশৃংখলার চুড়ায় উঠতে আমাদের পিছন থেকে ঠেলছে।
কে কথা কয় উপন্যাসের নির্মম জগত এই সমাজেরই বিম্ব। উপন্যাসের অধিকাংশ মূল চরিত্রের পরিণতি আমাদের বলে যে জীবন হয়ত অনেকটাই কর্মযোগের ফলাফল। যে ক্ষয়িষ্ণু সমাজের আমরা উত্তরাধিকার, তার ক্ষয়প্রাপ্তির দুঃসংবাদ আমাদের বইতে হবে।
তবে মানুষের ঘুরে দাঁড়াবার সুযোগ ফুরিয়ে যায়নি, এটা বিশ্বাসযোগ্য করতে হুমায়ূন আঁকেন কোর্টরুম ড্রামার একটি শক্তিশালী দৃশ্য। নিশুর ধর্ষন মামলায় মতিন ও ব্যরিস্টার সালেহ ইমরান তার পাশে দাঁড়ান। একইভাবে পাহাড়ে আশরাফের যে অলৌকিক স্বপ্ন মিশ্রিত জীবনের কথা আমরা জানতে পারি মতিনের কাছে লেখা চিঠি মারফত, সেটা হতে পারে মানব সম্প্রদায়ের কাঙ্ক্ষিত ইউটোপিয়ারই একটা রূপক।
৭
লেখাটির শেষে পুনরায় টেনে আনছি বইয়ের ভূমিকায় বর্ণিত কথাগুলো, যা শুরুতে উল্লেখ করেছিলাম।
হুমায়ূনের ভাষ্যমতে গল্পের বীজ অটিজমে আক্রান্ত এক শিশুর জীবনীতে লুকিয়ে ছিল, এবং আমার আলাপে এটা পরিষ্কার করেছি যে কেবলমাত্র মানসিক ভারসাম্যহীন একটি শিশুকে নিয়ে উপন্যাস ফাঁদা হুমায়ূনের অভিষ্ট ছিলনা।
অস্থির প্রহর পার করতে থাকা সমাজ একজন লেখকের অস্তিত্বকে প্রতিনিয়ত খুঁচিয়ে যায়। মুহূর্তেই তিনি কিছু লিখে ফেলেন এমন নয় কিন্তু এ খোঁচা তার হৃদয়ে দিনের পর দিন ক্ষত সৃষ্টি করবে এমনটাই সম্ভাব্য। হুমায়ূন ছিলেন একটা ভাল রূপকের সন্ধানে, যার আড়াল নিয়ে তার আবিষ্কৃত আত্ম-সামাজিক জটিলতাগুলোকে লিখে ফেলা যাবে।
কে কথা কয় সে অর্থে এক রকমের রিভোল্ট। লেখকের বয়ে বেড়ানো ক্ষতগুলোর কিম্ভূত আয়না। পাশাপাশি যা হাস্যরসাত্মক অথচ বিষাদের কড়চা। সরাসরি কোন কিছু বলা হয়না, তবে এর গল্পময় ডায়ালজিকাল পরিবেশেও অন্তর্গত বিদ্রুপটি পাঠক টের পান, চারপাশে ভিন্ন দৃষ্টিতে তাকাবার এক নিম্নচাপ আখ্যানটি সৃষ্টি করে।

এনামুল রেজা: কথাশিল্পী। প্রথম উপন্যাস কোলাহলে’র জন্য পেয়েছেন ‘বাংলানিউজ নির্বাচিত তরুণ ঔপোন্যাসিক’ পুরষ্কার (২০১৫)।
লেখাটি তথ্যবহুল ছিলো, ধন্যবাদ
LikeLike