প্রবন্ধ / বই আলোচনা

দ্য বুক থিফ – যুদ্ধদিনের মানুষ ও মৃত্যুর আখ্যান | এনামুল রেজা

Book thief review by Enamul Reza mohapoth

“সবার আগে রঙ, এরপর মানুষ। এভাবেই আমি দেখি, অন্তত দেখতে চেষ্টা করি।”

কথাগুলো আমার না—মৃত্যুর। সে খুব আগ্রহ নিয়ে গল্পটা শুনাবে আমাদের। যুদ্ধের ডামাডোলে যদিও তাকে খুব ব্যাস্ত সময় কাটাতে হচ্ছিল, তবু সে গল্পটা বলে গিয়েছে: বালিকা থেকে কিশোরী হয়ে উঠতে থাকা এক মেয়ের গল্প, যুদ্ধের মাঝে কিছু  নিরপরাধ সাধারণ মানুষের বিষাদের গল্প, নাকি আখ্যানটি শুধুই হিমেলস্ট্রিটের? হিমেলস্ট্রিট মানে স্বর্গের রাস্তা।

অস্ট্রেলিয়ান উপন্যাসিক মার্কাস যুসেকের দ্য বুক থিফ নিয়ে লিখতে বসলাম কিংবা বসতে হল। বইটা যারা শেষ করেছেন, তাদের জানবার কথা আসলে এ বই শেষ করে বসে থাকা কঠিন। আমার শুরু হয় একটা তীব্র শীতের রাতে: জানালার ওপাশে গাঢ় অন্ধকার, জানালার কাঁচে কুয়াশার ঘোলাটে আমেজ, মশারীর ভিতর কম্বল জড়িয়ে আমি শুরু করি পাঠ। মা দেশান্তরি, বাবা নিখোঁজ, যাত্রাপথে একমাত্র ছোটোভাই মারা গেছে এমন এক মেয়ের গল্প। মেয়েটি সব হারিয়ে বসবাস করতে শুরু করেছে তার পালক পিতা-মাতার কাছে।

সাল ১৯৩৮। হিটলারের নাৎসি জার্মানি। ৩৩ হিমেলস্ট্রিট, মলকিং। পুরো জার্মানি চলছে এডলফ হিটলারের কড়া অনুশাসনে: ইহুদি নিধন হচ্ছে, চলছে কমিউনিস্টদের বইপত্র পুড়ানো। এরমাঝেই বইছে হিমেল স্ট্রিটের সাদামাটা দিবস-রজনী। পালক পিতা-মাতা হুবারম্যানদের সাথে দিন কেটে যাচ্ছে বালিকা লিজেল মেমিংগারের।

হুবারম্যান দম্পতি দুজন দু’রকম: রোজা হুবারম্যান কড়া মেজাজী, রুক্ষ স্বভাবের ছায়া তার চেহারাতেও পড়েছে, যাকে বলে কাষ্ঠচেহারা, নিরস আর কঠিন। অন্যদিকে হ্যানস হুবারম্যান সৌম্য আর মমতার উজ্জ্বল মূর্তি—প্রধান কাজ চোখের সামনে থাকা সমস্ত কিছুতেই একটা স্নেহের ছায়া ফেলে রাখা আর প্রিয় একর্ডিয়নে স্বর্গীয় সুর তোলা। এপ্রোচ ভিন্ন হলেও, পালিতকন্যা লিজেলকে মূলত এরা দুজনেই ভালবাসতে শুরু করেন আপন কন্যার মতই।


একটা বক্সিং রিঙ, দুজন বক্সার- একজন ম্যাক্স, অন্যজন স্বয়ং এডলফ হিটলার। এদের মুষ্টিযুদ্ধ ধুন্ধুমার হয়ে ওঠে, এক পর্যায়ে ম্যাক্স ধরাশায়ি করে ফেলে হিটলারকে, তার বিচিত্র গোঁফের উপর ঘুষি চালাতে থাকে অনবরত।


পাশের বাড়ির সমবয়সি বালক রুডি স্টেনারের গল্পটি আরও মজাদার। দৌড়ের উপর তার অবসেশন আছে। যে বিষয়টিকে আমাদের ন্যারেটর মৃত্যু ঘোষনা করেছে জেসি ওয়েনস ইনসিডেন্ট হিসেবে।

জেসি ওয়েনস ১৯৩৬ অলিম্পিক জয়ী দৌড়বিদ। সেই সময়ের পশ্চিমের সবচেয়ে দ্রুততম মানব। রুডি চাইতো সে একদিন জেসি ওয়েনস হবে, দৌড়ে বিশ্বজয় করবে কিন্তু লোকটাতো কৃষ্ণাঙ্গ আর রুডি শ্বেতাঙ্গ, সুতরাং সে একদিন তার সারা গায়ে হাঁড়ির কালি মাখলো এবং নেমে গেল হিমেলস্ট্রিটের দর্শকশূন্য রেসট্র্যাকে। দৌড়তে লাগলো এমাথা থেকে ওমাথা।

হলদেচুলো বালক রুডি স্টেনার হয়ে ওঠে লিজেল মেমিংগারের বন্ধু। সবচেয়ে কাছের বন্ধু। তারা একসাথে স্কুলে যায়, কিংবা এ্যাম্পার নদীর ব্রিজে দাঁড়িয়ে গল্প করে। রুডি একদিন ঘোষনা দেয়, লিজেল চল আমরা দৌড়ের প্রতিযোগিতা করি।

তারপর?

দৌড়ে যদি আমি জিতে যাই, তুই আমাকে চুমু খাবি।

লিজেল হাসিমুখে জবাব দেয়, তোকে চুমু খাবো? আমার বয়ে গেছে। সাউমেঞ্চ! (বইটিতে সাউমেঞ্চ শব্দটিকে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছেন লেখক, এর অর্থ শুয়োর)।

গল্পের এক গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র হিসেবে এরপর আমাদের সামনে হাজির হয় ম্যাক্স ভন্ডেনবার্গ। ইহুদি যুবকটি হ্যানসেরর বন্ধু এরিক ভন্ডেনবার্গের ছেলে, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় যে বন্ধু হ্যানসের জীবন বাঁচিয়েছিল। কৃতজ্ঞ হ্যানস জীবনের ঝুঁকি নিয়েই ম্যাক্সকে নিজের বাসায় আশ্রয় দেয়।

২য় বিশ্বযুদ্ধের সময় হিটলারের নাৎসি জার্মানিতে একজন ইহুদিকে আশ্রয় দেওয়া কতটা ভয়ংকর ছিল, সেটা নতুন করে বলার কিছু নেই তবু সুপ্রিয় মৃত্যু কিন্তু একটা উদাহরণ আমাদের দেবে। ধরা যাক, কেউ আপনার দুগালে সমানে চড় মেরে যাবে অথচ আপনাকে বাধ্য হয়ে সেটা মেনে নিতে হবে মুখে হাসি ধরে রেখেই!

ম্যাক্স একজন বক্সার ছিল, অন্তত তার নিজের এলাকায় বেশ বিখ্যাত ছিল সে। লিজেলদের বেজমেন্টে বসবাসকালে সে ওই বক্সিংয়েই মজে থাকার চেষ্টাটা খুব করে যেত। একটা বক্সিং রিঙ, দুজন বক্সার- একজন ম্যাক্স, অন্যজন স্বয়ং এডলফ হিটলার। এদের মুষ্টিযুদ্ধ ধুন্ধুমার হয়ে ওঠে, এক পর্যায়ে ম্যাক্স ধরাশায়ি করে ফেলে হিটলারকে, তার বিচিত্র গোঁফের উপর ঘুষি চালাতে থাকে অনবরত। হিটলারকে তখন আমাদের আবিষ্কার করতে হয় ছলনাময় রূপে—ম্যাক্সের সাথে একা সুবিধা না করতে পেরে সে দর্শকদের প্রভাবিত করবার চেষ্টা করে তার মোহনীয় ভাষনে, ওতে কাজ হয়—সমস্ত নাৎসি দর্শকেরা হুড় দিয়ে বক্সিং রিঙে ঢুকে পড়ে। এরপর ম্যাক্স ভন্ডেনবার্গ তার মুষ্ঠি চালাতে শুরু করে সেই অজস্র নাৎসি দর্শক আর হিটলারের বিরুদ্ধে। ছোট্ট দৃশ্যকল্পটি থেকে অনুমান করে নিতে কষ্ট হয়না যুদ্ধ কিংবা হিটলার কী বিভীষিকাই না নিয়ে এসেছিল সেসব দিবস রজনীময়।

সময় গড়ায় তার নিজের মতই। হিমেলস্ট্রিটের বাসিন্দাদের জীবনে এগিয়ে আসে দুর্দশা, খাদ্যাভাব। রুডি আর লিজেল এলাকার ছেলেদের সাথে বিভিন্ন ফসলের ক্ষেত কিংবা আপেল বাগানে চুরির অভিযানে নামে। ক্ষুধার তাড়না বড় কষ্টকর তাড়না।

লিজেল মেমিংগার কেন বুক থিফ? এতসব গল্পের মাঝে সেই আখ্যান আমাদের সন্ধান দেয় ভিন্ন জগতের। লিজেল তার প্রথম বইটা হস্তগত করে বরফে মোড়া কবরস্থান থেকে: তার ভাইকে যখন গোরখোদকেরা কবরে নামাচ্ছে, একজনের কোটপকেট থেকে বরফাবৃত মাটিতে পড়ে বইটা, সকলের অলক্ষ্যে তা হাতে তুলে নেয় লিজেল, বইয়ের নাম- গোরখোদকদের সহায়ক পুস্তিকা (The Gravediggers Handbook)।

সেই শুরু: দিনের নিয়ম-কানুনে চলতে থাকে দিন, যখন রাত আসে হ্যানস হুবারম্যান আর তার পালক কন্যা লিজেল শুরু করে ভ্রমণ, সেটি বইয়ের পাতায় পাতায় পিতা-কন্যার এক অলৌকিক ভ্রমণ।

বাবা হ্যানস পড়ে শুনাচ্ছেন গোরখোদকদের সহায়ক পুস্তিকা—লিজেল মুগ্ধ শ্রোতা। এভাবেই একদিন বালিকাটি পড়তে শিখে যায়, তার মাঝে তৈরি হয় পাঠের এক তীব্র ক্ষুধা। জীবন বাজী রেখে সে মেয়রের লাইব্রেরী থেকে বই চুরি করে আনতে শুরু করে যদিও লিজেলের দাবি, সেসব বই আদতে সে নিয়ে আসে ধার করে। এক স্নেহময় পিতা আর আদুরে কন্যাই মূলত ছিল এসব বইয়ের পাঠক, পরে এ দলে যোগ দেয় বক্সার ম্যাক্স ভন্ডেনবার্গ। এরপর?

the_book_thief_review mohapoth enamul reza

২০০৫ এ বইটা যখন বের হয়, আন্তর্জাতিক পাঠক মহলে রীতিমত সাড়া পড়ে যায়। এত সাধারণ একটা গল্প কিন্তু পড়তে পড়তে পাঠক আবিষ্কার করে—আসলে এই সাদামাটা জীবনের চেয়ে অসাধারণ আর কি আছে জগতে?

পশ্চিমের টানটান ক্রাইম থ্রিলার, হরর ফিকশন আর ফ্যান্টাসির যুগেও কী জীবনমুখী নিরেট, নিস্তরঙ্গ বাস্তবের গল্প দা বুক থিফ। ১৯৩৮ থেকে ১৯৪৩ সময়কাল, এর মাঝে বলার মত অজস্র মহাকাব্যিক আখ্যান ইতিহাস কিন্তু ধরে রেখেছে। যুসেক করলেন কী, বেছে নিলেন মিউনিখের খুব কাছের শহর মলকিং-কে। তাও পুরো মলকিং না, এর একটা এলাকা হিমেলস্ট্রিট। ছয়টা বছরে পৃথিবী অনেক বদলে গিয়েছিল, সেই ভয়ানক অদল বদলময় ছ’বছরের গল্প করে গেলেন ওই হিমেল স্ট্রিট থেকে—এর সাথে যোগ হল তার আকর্ষনীয় গল্পভঙ্গি, ভিন্নরকম আঙ্গিক ও উপন্যাস কাঠামো। 

হিটলারের নাৎসি জার্মানি কেমন ছিল, কেমন ছিল সেসময় সাধারণ জার্মানবাসীর জীবন? রাশিয়া আক্রমণ করবার পর থেকেই মূলত হিটলার সাম্রাজ্যের যে পতন শুরু হয়, তার ভয়ংকর আঁচ জার্মানের সাধারণ মানুষকেও মৃত্যুর মুখোমুখি করে দিয়েছিল অর্থাৎ নাৎসি জার্মানির ব্যার্থতার দিকটি খুব পরিষ্কারভাবে এঁকেছেন যুসেক।

দীর্ঘ দিনের যুদ্ধ জার্মানে তৈরি করেছিল স্থায়ি খাদ্যসংকট, নিতান্ত ঘরোয়া লোকজনকে বাধ্য করা হয়েছিল ইহুদি নিধন কিংবা সরাসরি যুদ্ধে—এ আদেশ অমান্য করলে শাস্তি ছিল মৃত্যুদন্ড।

শান্তিকামী ও সৎ একজন মানুষ কখনও তো চাইবেনা এটা, চিরচেনা প্রতিবেশি শুধু ভিন্ন ধর্মাবলম্বি হবার অপরাধে তাকে সৈন্যদের কাছে ধরিয়ে দিতে। এই শান্তিকামী জনগণের মেটাফোর ছিল হিমেলস্ট্রিটের বাসিন্দা রূপালি চুলের হ্যানস কিংবা কাষ্ঠচেহারার রোজা কিংবা আরও অনেকে, যুদ্ধ যাদের জীবনকে তছনছ করে দিয়েছিল।

উপন্যাসের প্রধান থিম হিসেবে অনেক সমালোচক তুলে এনেছেন সাহসের ব্যপারটা। হ্যানস শুধু শান্তিকামীই ছিলনা, তার সাথে যোগ হয়েছিল বিপুল সাহস: জার্মান সৈনিকদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে যাত্রারত একজন ক্ষুধার্থ ইহুদিকে রুটি দেবার ঘটনাটা তো আসলে দুর্মর সাহসেরই উদাহরণ। হিটলারের মুখোমুখি ম্যাক্সের যে বক্সিঙের দৃশ্যকল্পটি, বিপুল সাহস ধারণ না করলে পলাতক অবস্থায় অমন দৃশ্য কল্পনা করা ম্যাক্সের পক্ষে সম্ভব হতনা। 

অমন পরিস্থিতিতে একজন ইহুদিকে নিজ বাড়িতে আশ্রয় দেওয়া কেমন অসম্ভব কাজ ছিল, পূর্বে উদাহরণ দিয়েছি কিংবা লিজেলের জন্য শীতের বরফঠান্ডা এ্যাম্পার নদীতে রুডির ঝাঁপিয়ে পড়াটাও সাহসের জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত।

অন্যদিকে যে শব্দের জগৎ লিজেল মেমিংগারের সামনে খুলে দেয় স্বপ্নের এক দুয়ার অথচ একসময় এই শব্দই হয়ে ওঠে তার শাঁখের করাত, এ ব্যাপারটিও উপন্যাসের খুব উল্লেখ্য বিষয়। ধ্বংস আর সৃষ্টির যে বিপুল ক্ষমতা শব্দ ধারণ করে, মার্কাস যুসেক এ চিরন্তন ব্যাপারটিই আমাদের সামনে উন্মোচন করেছেন আশ্চর্য দক্ষতায়।

একদিন এক কিশোর তিনটি জিনিস ঠিক করে নিল—
ক. বড় হয়ে সে মাথার ডানপাশে সিঁথি কাটবে।
খ. বিচিত্র গোঁফ রাখবে।
গ. একদিন সে এই বিশ্ব শাসন করবে।

আখ্যানটি পড়তে গিয়ে পাঠককে আবিষ্কার করতে হয় এ তিনটি ইচ্ছে পুরণের পথে মাত্র একজন লোক কত অসংখ্য মানুষের স্বপ্নের কবর রচনা করেছিলো, রচনা করেছিল কী বিপুল ধ্বংসের মহাকাব্য।

মানবতার এ দুঃখবোধ যুসেক আমাদের শুনিয়েছেন মৃত্যুর জবানীতে। যে মৃত্যু মূল চরিত্র লিজেল মেমিংগারের একান্ত আপন, সকল মানুষেরও শেষ সঙ্গী কি সেই নয়?

দ্য বুক থিফ এমন গল্প, যা মগজে স্থায়ী এক আবেশ তৈরি করে—সাড়ে পাঁচশো পৃষ্ঠার বিশাল উপন্যাসটি শেষ করার পরেও মনে হয়, আর কেন নেই? কেন এমন হয় জীবন?

এসব প্রশ্ন যখন মাথায় ঘোরে, শীতের প্রলয়ংকরী রূপ অস্তমিত হয়। বসন্তের আগমনী বাতাস আমার জানালার ওপাশে নাচানাচি করতে থাকে। হু হু করা বাতাসের সেই হাহাকার তখন নাচতে শুরু করে হৃদয়েও। মহৎ সাহিত্যের কাজই তো এই: হাহাকার আর প্রশ্ন তৈরি করা।


Enamul Reza এনামুল রেজা

এনামুল রেজা: কথাশিল্পী। প্রথম উপন্যাস কোলাহলে’র জন্য পেয়েছেন ‘বাংলানিউজ নির্বাচিত তরুণ ঔপোন্যাসিক’ পুরষ্কার (২০১৫)।

লেখা সম্পর্কে মতামত জানাতে ফেসবুক অথবা ইমেল ব্যবহার করুন।